লোকসভা নির্বাচনে হুগলি কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে বিজয়ী হলেন তৃণমূল প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজনীতির মাঠে একে অপরের বিপক্ষে লড়াই করলেও আদতে দুই প্রার্থীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। দু’জনেই অভিনেত্রী। পেশার সূত্রেই দু’জনের বন্ধুত্ব। প্রায় দীর্ঘ ১৭ বছরের বন্ধুত্ব রয়েছে লকেট এবং রচনার। রাজনীতির লড়াইয়ে নেমে একে অপরকে কখনও কটু কথায় আক্রমণ করেননি।
প্রথম দিন প্রচারকেন্দ্রে যাওয়ার পথে চারিদিকে শুধু ‘ধোঁয়া’ দেখেছিলেন রচনা। ২০ মে হুগলি কেন্দ্রে লোকসভা ভোট হয়েছিল। ফলপ্রকাশের আগের দিন গণনাকেন্দ্র ঘুরে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘সবার উপর মানুষ সত্য।’’ ভোটের ফলাফল যা হবে, তা মেনে নেবেন তিনি।
আনন্দবাজার অনলাইনকে অভিনেত্রী জানিয়েছিলেন, ভোটের প্রচার থেকে ছুটি পেলে ছেলের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটাতে চান তিনি। প্রাগ দেশেও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।
হুগলি কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ানোর পর সমাজমাধ্যমে রচনাকে নিয়ে মিমের ছড়াছড়ি শুরু হয়ে যায়। একাংশের মতে, ‘নেত্রীসুলভ’ আচরণ অপেক্ষা যেন ‘নায়িকাসুলভ’ হাবভাব বেশি রচনার। কিন্তু শেষ বিচারে শেষ হাসি হাসলেন তিনিই।
অন্য দিকে, বিপক্ষে দাঁড়ানো টলি অভিনেত্রী লকেট অভিনয়জগৎ থেকে এখন বহু দূরে। বরং, রাজনীতিক হিসাবে নিজেকে পাকাপোক্ত করে তুলেছেন তিনি। তবু হারতে হল রাজনীতিতে নবাগতার কাছে।
এ বার লোকসভা নির্বাচনে হুগলিতে আসলে ‘তারকা-যুদ্ধ’ হল। অভিনয় জগতের দুই অভিনেত্রী ভোটযুদ্ধে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।
বড় পর্দা থেকে ছোট পর্দা, বিনোদন জগতে রচনা ‘দিদি নম্বর ওয়ান’। রাজনীতির মঞ্চে নেমেছিলেন নিজের সতীর্থের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে। সেই যুদ্ধেও ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ হলেন রচনা।
জমি আন্দোলনের ধাত্রীভূমি সিঙ্গুর থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজের রাজনৈতিক জীবনের সফর শুরু করেছেন লকেট। বিজেপি প্রার্থী লকেটের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর বলে দাবি করেন রচনা। দু’জনের সুসম্পর্কের কথা মেনেছেন লকেটও।
দীর্ঘ ১৭ বছরের বন্ধুত্ব রচনা এবং লকেটের। ভাগ্যের ফেরে লোকসভা ভোটে তাঁরা প্রতিপক্ষ। তবে অভিনয় জীবনে রচনা অনেকটা প্রবীণ হলেও রাজনীতিতে এগিয়ে ছিলেন লকেট। কিন্তু ভোটের ফল সেই অঙ্ক বদলে দিল।
২০২৪-এর লোকসভার ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়ান রচনা এবং লকেট। রাজনীতির দুনিয়ায় লকেটের পরে যাত্রা শুরু করলেও অভিনয়জগতে লকেটের চেয়ে প্রায় বছর নয়েক আগে পা দেন রচনা।
‘কর্তব্য’ ছবিতে প্রথম বার একসঙ্গে কাজ করেছিলেন লকেট এবং রচনা। তার পরে একের পর এক সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছেন দুই অভিনেত্রী।
‘মায়ের আঁচল’, ‘পরিবার’, ‘অগ্নি’, ‘ত্যাগ’— দু’বছরের মধ্যে পাঁচটি সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন হুগলির দুই প্রার্থী রচনা এবং লকেট। ‘জন্মদাতা’, ‘চাওয়া পাওয়া’র মতো ছবিতেও কাজ করেছেন তাঁরা।
বড় পর্দায় রচনা এবং লকেট কখনও জায়ের চরিত্রে, কখনও বা বান্ধবীর চরিত্রে। তবে মিলের চেয়ে দুই চরিত্রের মধ্যে অমিলই যেন বেশি দেখা গিয়েছিল পর্দায়।
বরাবরই ছবির নায়িকা রচনা এবং খানিকটা হলেও ‘দুষ্টু’ চরিত্রে লকেট। ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হঠাৎ একদিন’ ছবিতে একসঙ্গে শেষ কাজ করতে দেখা যায় দু’জনকে।
২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গোয়েন্দা গোগোল’ ছবিতে গোগোলের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রচনা। ২০১৪ সালে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় পরিচালিত ‘রামধনু’ ছবিতেও অভিনয় করেন রচনা।
২০১৪ সালে ‘গোগোলের কীর্তি’ ছবিতে গোগোলের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন লকেট। এক বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘গোয়েন্দা গোগোল’ ছবিতে একই চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল রচনাকে।
২০১৭ সালে শেষ বড় পর্দায় দেখা যায় রচনাকে। ‘হঠাৎ একদিন’ ছবিতে অভিনয়ের পর সাত বছর আর বড় পর্দায় দেখা যায়নি রচনাকে।
ছাত্রীজীবনে নাচ এবং অভিনয় নিয়ে আগ্রহী ছিলেন লকেট। মেয়ের আগ্রহ দেখে মা ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন নাচের স্কুলে। তার পর নাচ থেকে অভিনয়জগতে পদার্পণ লকেটের।
লকেট অভিনয়ের প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন ছোট পর্দায়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘বেহুলা’, ‘ভালবাসা থেকে যায়’ এবং ‘মা মনসা’র মতো একাধিক বাংলা ধারাবাহিকে অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে।
বড় পর্দারও জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন লকেট। ‘মায়ের আঁচল’, ‘পরিবার’, ‘অগ্নি’, ‘ত্যাগ’, ‘ক্রান্তি’, ‘অভিমন্যু’, ‘মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট’, ‘শুভদৃষ্টি’, ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’, ‘লে হালুয়া লে’, ‘অভিশপ্ত নাইটি’ এবং ‘খোকাবাবু’র মতো বহু বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। তার পর অভিনেত্রী লকেটের জীবনে রাজনীতির অধ্যায় শুরু হয়।
টলিউড অভিনেত্রী লকেট রাজনীতিতে এসেছিলেন অধুনা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের মারফত তৃণমূলে যোগ দিয়ে। খুব বেশি দিন অবশ্য তিনি ঘাসফুলে থাকেননি।
ঘাসফুল থেকে লকেট চলে যান পদ্মফুলে। সংগঠন সামলাতে সামলাতে সাংসদ। তাঁকে অনেকে বলে থাকেন ‘বঙ্গ বিজেপির লক্ষ্মী’। এ বার কি সেই ‘খেতাব’ বদলাবে? লোকসভা এবং বিধানসভা মিলিয়ে তিন-তিনটি ভোটে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কিন্তু সে সব কাজে দিল না।
২০১৭-১৮ সাল থেকেই অভিনেত্রীর খোলস ছেড়ে মাঠঘাটের সক্রিয় রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছিলেন লকেট। তার আগে ২০১১ সালে তৃণমূলে এবং ২০১৪ সালে বিজেপিতে যোগ দিলেও অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন লকেট।
লকেটের চেয়ে বিনোদন জগতে ‘সিনিয়র’ এবং রাজনীতিতে ‘জুনিয়র’ রচনা। রাজনীতি এবং সিনেমা দু’টি আলাদা বিষয়। বড় পর্দার সতীর্থের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে জিতে গেলেন ‘দিদি নম্বর ওয়ান’। ভোটের অঙ্কে পিছিয়ে পড়লেন বিজেপির ‘প্রতিবাদী’ মুখ।