মাত্র ১০ মিনিট। চোখের সামনে দিয়ে বাঁধের একাংশ ভেসে যেতে দেখলেন। সেই জলের তোড়ে প্রায় ভেসেই যাচ্ছিলেন। কোনও মতে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছেন তাঁরা। তিস্তায় আসা হড়পা বানের জেরে চুংথাম বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। সেই বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মী এবং আধিকারিকেরা এমনটাই জানিয়েছেন।
চুংথামের এই বাঁধটি সিকিমের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। যার নাম সিকিম উর্জা। আগে যেটির নাম ছিল তিস্তা উর্জা। মঙ্গলবার রাতে হড়পা বানে এই বাঁধেরই একাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
সিকিম উর্জা লিমিটেডের এগজ়িকিউটিভ চেয়ারম্যান সুনীল সারাওগি এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “রাত তখন ১১টা ৫৮ মিনিট। ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি)-এর কাছ থেকে আমাদের কাছ খবর আসে তিস্তায় হড়পা বান এসেছে। সেই খবর পেয়েই আমাদের দল বাঁধের গেট খুলতে যায়। কিন্তু সেই সুযোগ পাওয়া যায়নি। তার মধ্যেই বিপুল জলরাশি এসে বাঁধের দেওয়ালে ধাক্কা মারে। চোখের নিমেষে ভেসে বেরিয়ে যায় বাঁধের বিশাল অংশ।”
সারাওগি আরও বলেন, “আমাদের দলে ১২-১৩ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন বাঁধের অন্য পাশে আটকে পড়েছিলেন। বুধবার দুপুর ২টোয় তাঁদের উদ্ধার করে আইটিবিপি। ২০০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু বাঁধের পাওয়ারহাউসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সেতু নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। জলের তলায় চলে গিয়েছে পাওয়ারহাউসও।’’
২০২২ সালে তিস্তার উপর চুংথাম এবং মঙ্গনে ১২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎপ্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছিল। এই প্রকল্পে সিকিম সরকারের ৬০.০৮ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে। ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই প্রকল্পটি গড়ে তোলা হয়েছে।
সিকিম উর্জা সূত্রে খবর, বাঁধের একাংশ ভেঙে যাওয়ায় প্রায় ৫১ লক্ষ কিউবিক মিটার জল একসঙ্গে তিস্তা দিয়ে বয়ে গিয়েছে। এই বিপুল জলরাশি পাহাড়ি এলাকা থেকে নীচের দিকে নামতে শুরু করে। আর তাতেই বড় বিপর্যয় ঘটেছে সিকিমে।
এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, এই বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় প্রকল্পের যেমন ক্ষতি হল, তেমনই পরিবেশের বিশাল ক্ষতিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, বাঁধটি পুনর্নির্মাণে আবার কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। শুধু তাই-ই নয়, বিষয়টি সময়সাপেক্ষও বটে।
সিকিম উর্জার এগজ়িকিউটিভ চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, গত এক বছর ধরে যথেষ্ট আশাপ্রদ ফল পাওয়া যাচ্ছিল এই প্রকল্প থেকে। কিন্তু এই বিপর্যয় সেই গতিতে বাধ সাধল। তিনি আরও জানান, মঙ্গনের পাওয়ারহাউসের কী অবস্থা এখনও জানা যায়নি। সেতু ভেঙে যাওয়ায় ওই পাওয়ারহাউসে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
মঙ্গলবার গভীর রাতে উত্তর সিকিমের দক্ষিণ লোনক হ্রদের উপর মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়। ফলে হ্রদের দেওয়াল ফেটে বিপুল জলরাশি পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে আসে। সেই জল তিস্তায় এসে পড়ে। ফলে তিস্তার জলস্তর ১৫-২০ ফুট বেড়ে যায় এবং বিপুল জলরাশি তিস্তার দু’পাড়ে ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে এগিয়ে যায়।
সিকিম প্রশাসন সূত্রে খবর, উত্তর সিকিমের মঙ্গন জেলা এবং পূর্ব সিকিমের পাকিয়ং এবং গ্যাংটক এই হড়পা বানে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মঙ্গনে।
সিকিমের এই বিপর্যয়ে এখনও পর্যন্ত ১২০ জন নিখোঁজ হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। ২২ সেনা জওয়ান নিখোঁজ। তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বছরের মার্চে কেন্দ্র সরকার সংসদে হিমাচল অঞ্চলে হিমবাহ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ করেছিল। সেই রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, ওই অঞ্চলে হিমবাহগুলি গলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের হিমবাহ সৃষ্ট নদীগুলি দুর্যোগ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিও এই দুর্যোগের শিকার হতে পারে।
গত দু’মাসে ভয়ানক বিপর্যয়ের সাক্ষী থেকেছে হিমালয়ের দুই রাজ্য উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশ। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এ বার বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে পড়ল সিকিম।