২ সেপ্টেম্বর সূর্যের দিকে পাড়ি দিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর মহাকাশযান আদিত্য-এল১। সূর্যের দিকে এই প্রথম কোনও মহাকাশযান পাঠাল ভারত। সূর্যের বায়ুমণ্ডল সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করবে আদিত্য-এল১। তবে সূর্যের বিষয়ে তথ্য জোগাড় করতে প্রথম মহাকাশযান পাঠিয়েছিল আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা।
নাসার পাঠানো সেই সৌরযানের নাম পার্কার সোলার প্রোব। পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের ১২ অগস্ট সূর্যের দিকে মহাকাশযান পাঠিয়েছিল নাসা। এখনও তা ঘুরছে সূর্যের চারপাশে।
পার্কার সোলার প্রোবের আগে সূর্যের অত কাছে কোনও মহাকাশযান যেতে পারেনি। কাছ থেকে ওই যান দেখেছে, সূর্য কী ভাবে সৌরজগতের উপর প্রভাব ফেলে।
অধ্যাপক ইউজিন পার্কারের নামে নাম রাখা হয়েছিল এই মহাকাশযানের। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনিই প্রথম সূর্যের কাছাকাছি মহাকাশযান পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এর আগে কোনও জীবিত ব্যক্তির নামে মহাকাশযানের নামকরণ হয়নি। ফ্লোরিডায় গিয়ে পার্কার সোলার প্রোব উৎক্ষেপণের মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন ইউজিন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৯১ বছর।
মহাকাশযানটি তৈরি করেছিল জনস হপকিন্স অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি। এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল সেই যান, যাতে সূর্যের ভয়ঙ্কর তাপ এবং তেজষ্ক্রিয়তা থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। অন্য একটি সংস্থা ওই যানের একটি যন্ত্র তৈরি করেছিল, যা সৌরবায়ু কেটে কেটে এগোবে।
বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, এই সৌরযানের থেকে বেশি দ্রুত গতিতে কোনও মহাকাশযান এর আগে ছোটেনি। ক্রমে গতিবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এই মহাকাশযানের। ২০২৪ সালে এই সৌরযানের গতি হবে ঘণ্টায় সাত লক্ষ কিলোমিটার। অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক থেকে টোকিয়োর দূরত্ব এই যান এক মিনিটেরও কম সময়ে অতিক্রম করবে।
২০২৪ সালে সূর্যের ৬২ লক্ষ কিলোমিটার দূর দিয়ে ছুটবে নাসার এই সৌরযান।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের মধ্যে প্রবেশ করে পার্কার। সেই থেকে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে সে।
সেই থেকে ক্রমে সূর্যের কাছে এগোচ্ছে নাসার সৌরযান। প্রতিনিয়ত নতুন তথ্য পাঠিয়ে চলেছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকে। পার্কার সোলার প্রোব প্রকল্পের বিজ্ঞানী নূর রাউয়াফি জানিয়েছেন, এই সৌরযানের পাঠানো তথ্য থেকে জানা গিয়েছে সূর্য কী ভাবে কাজ করে। কী ভাবে এই নক্ষত্র পৃথিবীকে প্রভাবিত করে।
এই সৌরযান থেকে পাঠানো তথ্য বলছে, সূর্যের পৃষ্ঠে অনেক বুদবুদ রয়েছে। সেই বুদবুদ থেকে ছলকে ওঠে উত্তপ্ত প্লাজমা। সূর্যের ভিতর থেকে সেই প্লাজমা বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ে পৃষ্ঠে। তার পর ক্রমে ঠান্ডা হয়ে যায়। তার পর আবার ঢুকে যায় সূর্যের অভ্যন্তরে।
গবেষকেরা মনে করেন, এই কারণেই সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর (করোনা) অনেক বেশি উষ্ণ হয়। গবেষকেরা সূর্যের বায়ুমণ্ডলে চৌম্বকীয় ‘জ়িগজ়্যাগ’ কাঠামোর হদিস পেয়েছেন।
পার্কার সোলার প্রোবের পাঠানো তথ্য থেকেই গবেষকেরা দেখেছেন, সূর্যের করোনা অমসৃণ। তাতে এবড়োখেবড়ো উচু অংশ রয়েছে। উপত্যকা রয়েছে। কোরোনা মসৃণ বলের মতো নয়।
নাসার গবেষকেরা জেনেছেন, সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে প্রচুর শক্তিকণা (এনার্জেটিক পার্টিকল)-র প্রতিনিয়ত বিচ্ছুরণ হয়। এগুলোর গতি থাকে খুব বেশি।
এই শক্তিকণার অস্তিত্ব গবেষকেরা আগে জেনেছিলেন। তবে তাঁরা যতগুলি কণা বিচ্ছুরণ হয় বলে মনে করেছিলেন, বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশি শক্তিকণার বিচ্ছুরণ হয়। তা ধরতে পেরেছে পার্কার সোলার প্রোব। সে এ-ও জানিয়েছে, কণাগুলির প্রকৃতিও ভিন্ন।
সূর্যকে প্রদক্ষিণের আগে শুক্রকেও প্রদক্ষিণ করেছিল পার্কার সোলার প্রোব। শুক্রের বায়ুমণ্ডলে যে চৌম্বকীয় তরঙ্গ রয়েছে, তার মাপও জানতে পেরেছে এই যান। শুক্রের খনিজের বিষয়েও অনুসন্ধান চালিয়েছিল এই সৌরযান।
সূর্যের দিকে যাওয়ার সময় একটি ধূমকেতুর পাশ দিয়ে গিয়েছিল পার্কার সোলার প্রোব। তখন ধূমকেতুর গতিবিধির বিষয়েও তথ্য জুগিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। উল্কাপাত নিয়েও তথ্য জুগিয়েছিল এই সৌরযান।
২০২২ সালে মারা যান পার্কার। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪। তার আগে পর্যন্ত এই সৌরযান এবং তার পাঠানো তথ্যের বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ করতেন প্রাক্তন অধ্যাপক।