পহেলগাঁওয়ের গণহত্যার পর বদলার আগুনে ফুটছে ভারত। পাকিস্তানের উপর প্রত্যাঘাত শানাতে কূটনৈতিক ও সামরিক— দু’ধরনের প্রস্তুতিই নিচ্ছে নয়াদিল্লি। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের এ হেন আক্রমণাত্মক রূপ দেখে ইসলামাবাদের কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আতঙ্কিত পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরও। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি? না কি লুকিয়েছেন কোনও গুপ্ত কুঠুরিতে? এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
পহেলগাঁও কাণ্ডের পর ইসলামাবাদের উপর নয়াদিল্লি চাপ বাড়াতেই সমাজমাধ্যমে জেনারেল মুনিরকে নিয়ে একাধিক খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়তেই পাক সেনাপ্রধান দেশে ছেড়ে চম্পট দিয়েছেন বলে জল্পনা তীব্র হয়েছে। সেই কারণেই গত কয়েক দিন ধরে তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না, দাবি সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সূত্রকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিও একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই সব প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। আর তাই নাকি তাঁর নাম ‘মিসিং ইন অ্যাকশন’ বা এমআইএতে রেখেছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর।
স্থানীয় সূত্রে জেনারেল মুনিরকে নিয়ে আরও একটি খবর সংবাদমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি হল, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কিছু অফিসারকে নিয়ে রাওয়ালপিন্ডির একটি বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন জেনারেল মুনির। যদিও এই দুই খবরই জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাক সেনাপ্রধান যে বহাল তবিয়তে আছেন, তা প্রমাণ করতে এ বার তাঁর ছবি প্রকাশ করল শাহবাজ় শরিফ সরকার।
গত ২৭ এপ্রিল জেনারেল মুনিরের একটি গ্রুপ ছবি এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দফতর। সেখানে একাধিক সেনা অফিসার এবং প্রধানমন্ত্রী শরিফের সঙ্গে পাক সেনাপ্রধানকে সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল ওই ছবি অ্যাবটাবাদের সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তোলা হয় বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ।
এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করা ছবির নীচে পাক পিএমও লিখেছে, “২৬ এপ্রিল অ্যাবটাবাদের কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমির (পিএমএ) ১৫১তম কোর্সের স্নাতক উত্তীর্ণ সেনা অফিসারদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ শাহবাজ় শরিফ এবং সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির।’’ উল্লেখ্য, ২০১১ সালে এই অ্যাবটাবাদ এলাকাতেই কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদনকে ফৌজি অপারেশন চালিয়ে নিকেশ করে আমেরিকা।
ইসলামাবাদ জেনারেল মুনিরের গ্রুপ ছবি প্রকাশ করলেও তাঁকে নিয়ে বিতর্ক থামছে না। ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার আবহে তিনি পরিবারের সদস্যদের বিদেশে পাঠিয়েছেন বলেও গুজব ছড়িয়েছে। এই বিষয়ে অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে শাহবাজ় প্রশাসন। রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর থেকেও দেওয়া হয়নি কোনও বিবৃতি।
পাকিস্তানের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ডন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অ্যাবটাবাদের সেনা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে নতুন অফিসারদের ‘পাসিং আউট’-এ ফের এক বার ভারতের বিরুদ্ধে বিষ উগরে দেন জেনারেল মুনির। নয়াদিল্লি আক্রমণ শানালে ইসলামাবাদ যে আত্মরক্ষায় সক্ষম, তা স্পষ্ট করেছেন তিনি। পাশাপাশি, ফের এক বার দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলে ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের বিষয়টিকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেন পাক সেনাপ্রধান।
যদিও ইসলামাবাদের এই ধরনের পদক্ষেপকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না নয়াদিল্লি। ইতিমধ্যেই দেশের সেনা সর্বাধিনায়ক (চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বা সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহানের সঙ্গে বৈঠক সেরেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে খবর, পাকিস্তানকে জবাব দিতে কী কী গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে দু’জনের। তবে এ ব্যাপারে কোনও তথ্য প্রকাশ্যে আনা হয়নি।
সিডিএস জেনারেল অনিল চৌহানের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ। গোটা পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ভারতের বিরুদ্ধে প্ররোচনামূলক প্রচারের জন্য পাকিস্তানের ১৬টি ইউটিউব চ্যানেলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। কোপ পড়েছে প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার শোয়েব আখতারের চ্যানেলের উপরেও।
পাক ইউটিউব চ্যানেলগুলির পাশাপাশি সংবাদ সংস্থা বিবিসি-কেও পহেলগাঁও কাণ্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদনের জন্য সতর্ক করেছে কেন্দ্র। কাশ্মীরে বেছে বেছে হিন্দু পর্যটকদের খুন করার বিষয়টিকে সন্ত্রাসবাদী হামলা না বলে জঙ্গি হামলা বলে বর্ণনা করে ঐতিহ্যবাহী এই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। এই নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বিবিসি-র ভারতীয় শাখার প্রধান জ্যাকি মার্টিনকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্র।
অন্য দিকে পহেলগাঁও হামলা নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছে ইসলামাবাদ। পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ বলেছেন, ‘‘কোনও প্রমাণ ছাড়া আমাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে দায়ী করা হচ্ছে। রাশিয়া, চিন বা অন্য কোনও পশ্চিমি দেশ এর তদন্ত করে দেখতে পারে।’’ বিশ্লেষকদের দাবি, কূটনৈতিক ভাবে ভারতকে চাপে ফেলতে ওই মন্তব্য করেছেন তিনি।
পাকিস্তানের এই নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবিকে সমর্থন করেছে চিন। বেজিঙের সরকারি সংবাদ সংস্থা গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোটা ঘটনার উপর নজর রাখছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সরকার। পাক বিদেশমন্ত্রী তথা উপপ্রধানমন্ত্রী ইসাক দারের সঙ্গে ড্রাগনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র ফোনে কথা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
এই আবহে আবার সন্ত্রাস-বিরোধী বার্তা দিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ভারত এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের দিকে নজর রাখছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে আছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ব্যাপারে নয়াদিল্লিকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন জানিয়েছে ইজ়রায়েল। ইহুদিভূমির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। গোটা ঘটনাটিকে ইসলামীয় সন্ত্রাসবাদ বলে উল্লেখ করে এক্স হ্যান্ডলে পোস্টও করেছেন তিনি। ইজ়রায়েলের তরফে নয়াদিল্লিকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া পহেলগাঁও কাণ্ডে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। কাশ্মীরে হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীকে শোকবার্তা পাঠান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ আরও মজবুত ও জোরদার করতে আমরা সর্বদাই প্রস্তুত। এই নৃশংস অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই। সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং অপরাধীরা তাদের প্রাপ্য শাস্তি পাবেই।’’
এই ঘটনার এক দিনের মাথায় ১৯৬০ সালে হওয়া সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করে মোদী সরকার। এতে যে আগামী দিনে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে তীব্র জলসঙ্কট তৈরি হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে বিষয়টি নিয়ে সুর চড়িয়েছে ইসলামাবাদ। ভারত জল বন্ধ করলে, তাকে যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে শাহবাজ় সরকার।
এর পাশাপাশি ভারতকে পরমাণু যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রেলমন্ত্রী হানিফ আব্বাসি। তাঁর দাবি, ১৩০টি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের দিকে তাক করা রয়েছে। সূত্রের খবর, পরিস্থিতি খারাপ হতেই সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় হাতিয়ার এবং সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। ভারতের ঘাড়ের কাছে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
এ ছাড়া ভারতকে যুদ্ধের উস্কানি দিতে জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) সংঘর্ষবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ক্রমাগত গুলিবর্ষণ করে চলেছে মুনিরের ফৌজ। পাল্টা জবাব দিয়েছে এ দেশের সেনাও। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ভারত যাতে বদলা নিতে না পারে তার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করেছে পাকিস্তান। কিন্তু, সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে উপযুক্ত সময়ে ঠিকই জবাব দেবে নয়াদিল্লি।