আরবের তপ্ত বালিয়াড়িতে ছবির মতো সাজানো শহর দুবাই। প্রাচুর্যের শিখরে থাকা পশ্চিম এশিয়ার নগরটিকে আপন করে নিয়েছেন বিশ্বের ধনকুবেরদের একাংশ। ঠিক সেই আদলেই বালুচিস্তানের গ্বদরকে সাজিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তান। কিন্তু আরব সাগর লাগোয়া বন্দর শহরটি মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে দেখা গিয়েছে পড়শি দেশটির কাছে।
দীর্ঘ দিন ধরেই দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ইসলামাবাদ। এই অবস্থায় গ্বদরকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে পাক প্রশাসন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের দাবি, এতে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। গ্বদরের জন্য দিন দিন জলের মতো খরচ হচ্ছে ইসলামাবাদের। বর্তমানে সেই ধাক্কা সামলাতে রীতিমতো নাভিশ্বাস অবস্থা শাহবাজ় শরিফ সরকারের।
গ্বদর আশীর্বাদ না হয়ে কেন পাকিস্তানের কাছে অভিশাপ? সংবাদ সংস্থা এপিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ওই এলাকার বালুচ নাগরিকদের নাজেহাল দশা। বিষয়টিকে গোড়ার দিকে একেবারেই আমল দেয়নি ইসলামাবাদ। কিন্তু, সময়ের ফেরে সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে সামনে চলে এসেছে।
উদাহরণ হিসাবে গত বছরের বৃষ্টিপাতের কথা লিখেছে এপি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে টানা ৩০ ঘণ্টার বৃষ্টিতে একরকম ভেসে যায় বালুচিস্তানের ওই বন্দর শহর। রাস্তা থেকে সেতু পুরোপুরি জলের তলায় চলে যাওয়ায় গ্বদরের যোগাযোগ ব্যবস্থা একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
গত বছর মুষলধারে বৃষ্টির দাপট থামার অন্তত দু’দিন পর গ্বদরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিল পাক প্রশাসন। স্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বৃষ্টিতে বন্দর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি একাংশ ভেঙে মাটিতে বসে যায়। তৈরি হয় বিরাট বিরাট গর্ত। বছর ঘুরেও আর্থিক সঙ্কটের জেরে যা পুরোপুরি ঠিক করতে পারেনি ইসলামাবাদ।
গ্বদর সংক্রান্ত একটি রিপোর্টে ভয়েস অফ আমেরিকা জানিয়েছে, বর্তমানে সেখানকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বেঁচে থাকায় ন্যূনতম সুযোগসুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গ্বদরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তান। পর্যাপ্ত লগ্নি সত্ত্বেও এই প্রকল্প থেকে লাভের সম্ভাবনা কমছে বলে জানিয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।
পাক প্রশাসনের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে গ্বদরের জনসংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। গোটা এলাকাটি বালির টিলার উপর অবস্থিত। এর ঠিক নীচে রয়েছে আরব সাগর। আবহবিদেরা জানিয়েছেন, উচ্চতা কম হওয়ার কারণে বালুচিস্তানের বন্দর শহর এলাকাটির জলবায়ু অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রায় সারা বছর সেখানে থাকে শুষ্ক আবহাওয়া।
গ্বদরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিপদ নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন স্থানীয় প্রকৌশলী পাজ়ির আহমেদ। সংবাদ সংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘কোনও দ্বীপরাষ্ট্রের চেয়েও এর অবস্থা খারাপ হতে চলেছে। যে ভাবে জলবায়ু বদলাচ্ছে, তাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে গোটা এলাকাটিই তলিয়ে যাবে সাগরের অতল জলরাশির তলায়।’’
একটা সময়ে মৎস্যশিকার এবং পর্যটন শিল্পের জন্য পাকভূমিতে বিখ্যাত ছিল এই গ্বদর। কিন্তু, ২১ শতকে সেই পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। পাজ়ির জানিয়েছেন, দিন দিন সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বড় আকারের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বালুচিস্তানের বন্দর শহরটির উপকূলে। এর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলরেখা।
দ্বিতীয়ত, সমুদ্রের উপরিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মৌসুমি বাতাসের তেজ তীব্রতর হচ্ছে। কারণ উষ্ণ বায়ু বেশি পরিমাণে আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে। পাক প্রশাসনের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস পারদ চড়লে মৌসুমি বায়ুর জলীয় বাষ্প বহনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় সাত শতাংশ। এর জেরে ফি বছর প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে গোটা গ্বদর এলাকা।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির নেপথ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নকেও দায়ী করেছেন আবহবিদেরা। এর জেরে তীব্র হচ্ছে হিমবাহের গলন। ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্পিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানিয়েছে, ১৯১৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ১০০ বছরে করাচি সংলগ্ন আরব সাগরের জলরাশির উচ্চতা প্রায় আট ইঞ্চি বা ২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৪০ সালের মধ্যে এটি আরও আধ ইঞ্চি বা ১.৩ সেন্টিমিটার বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইসলামাবাদের অভিশাপ হয়ে ওঠার সর্বশেষ কারণ গ্বদরের স্থানীয় বিদ্রোহ। লম্বা সময় ধরে পাকিস্তানের থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বালুচ আমজনতা। প্রায়ই পাক ফৌজকে নিশানা করছে সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ। এদের আক্রমণে প্রাণ হারানো রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসার ও জওয়ানের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, গ্বদরের স্বাধীনতার দাবি যে ভাবে তীব্র হচ্ছে, তাতে অচিরেই গৃহযুদ্ধের মুখে পড়তে পারে ইসলামাবাদ। কারণ, সেখানকার সমস্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে একজোট করতে সক্ষম হয়েছে বিএলএ। পাশাপাশি পাক ফৌজের উপর হামলার তীব্রতা বৃদ্ধিতে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তারা। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি আবার খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশটিকে পাকিস্তানের থেকে আলাদা করার উদ্দেশ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের কাজে হাত লাগায় ইসলামাবাদ। প্রকল্পটির নাম রাখা হয়, ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’ বা সিপিইসি। এতে ড্রাগনভূমির শিনজ়িয়ান প্রদেশের কাশগড় থেকে বালুচিস্তানের গ্বদর বন্দর পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের কথা রয়েছে। প্রকল্পটিতে এখনও পর্যন্ত ৬,২০০ কোটি ডলার লগ্নি করেছে বেজিং।
এই প্রকল্প ঘোষণা হওয়া ইস্তক প্রতিবাদে ফেটে পড়েন বালুচিস্তানের সাধারণ মানুষ। চিনা বিনিয়োগকে কিছুতেই গ্বদরে ঢুকতে দিতে চাননি তাঁরা। বালুচ জনতার অভিযোগ, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এখানকার সামুদ্রিক মাছ শিকার একরকম চলে গিয়েছে চিনের কব্জায়। ফলে রোজগার প্রায় বন্ধ হওয়ার দশা হয়েছে তাঁদের।
সিপিইসি প্রকল্পে বালুচিস্তানবাসীদের কর্মসংস্থান হয়নি বললেই চলে। এতে মূলত কাজ করছেন চিনা ইঞ্জিনিয়ার এবং শ্রমিকেরা। গত কয়েক বছরে তাঁদের উপর বেশ কয়েক বার প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে বিএলএ। নাগরিকদের মৃত্যু হওয়ায় এই ইস্যুতে বেজিঙের ক্ষোভের মুখে পড়েছে পাক সরকার।
অন্য দিকে কিছু দিন আগেই গ্বদরের সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে ড্রাগনভূমিকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করার অভিযোগ ওঠে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের বিরুদ্ধে। সূত্রের খবর, চিনের কাছে ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’ প্রযুক্তি চেয়েছেন তাঁরা। সেটি হস্তগত হলে তবেই বালুচিস্তানের বন্দরটি বেজিঙের পিপল্স লিবারেশন আর্মির নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পাক সেনা।
বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কাছে রয়েছে ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’ প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে স্থল, বায়ু, সমুদ্র এবং সমুদ্রের গভীরে থেকেও পরমাণু হামলা চালাতে পারে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ফৌজ। আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পাশাপাশি এই প্রযুক্তি রয়েছে ভারতের হাতেও।
পাক সেনাকর্তাদের ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’ প্রযুক্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত আবদার মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে চিন। এতে বেজায় খাপ্পা রাওয়ালপিন্ডির পদস্থ কর্তারা। এক কথায় গ্বদরকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি যে জটিল হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে গ্বদরে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্বোধন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে একে চিনের উপহার বলে উল্লেখ করেন পাক রাজনৈতিক নেতারা। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বেজিং। বিমানবন্দর নির্মাণে ইসলামাবাদকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে দেয় ড্রাগন সরকার।
এপির রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিপিইসি প্রকল্পের জেরে পাক সরকারের কাঁধে চেপেছে চিনা ঋণের বিশাল বোঝা। প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ এবং স্থানীয় বিদ্রোহের জেরে এর নির্মাণকাজ যত পিছোবে, ততই বাড়বে সুদের অঙ্ক। এতে ভিতরে থেকে পাক অর্থনীতির ফোঁপরা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামাবাদের অতিরিক্ত চিন নির্ভরতাকে একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে প্রবল অর্থ সঙ্কটে থাকা পাকিস্তানের পক্ষে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়া বেশ কঠিন হবে। কারণ এই সংগঠনগুলির বকলমে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ওয়াশিংটনের হাতেই।