তুরস্কের গোবেকলি টেপ। ৯০-এর দশকে সেখানে প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লস স্কিমিডের একটি আবিষ্কার বদলে দিয়েছিল ইতিহাস। প্রকাশ্যে এসেছিল বহু অজানা তথ্য। কী ছিল সেই আবিষ্কার?
সময়টা ১৯৬৩ সাল। সানলিউরফা শহরে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে গিয়েছিল ইস্তানবুল এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক। শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে একটা জায়গায় গিয়ে বেশ অবাকই হয়েছিলেন তারা।
বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। তার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটিমাত্র মালবেরি গাছ। স্থানীয়েরা তাকে বলেন ‘উইশ ট্রি’ বা ‘ইচ্ছা গাছ’। ওই গাছের কাছে গিয়ে যা চাওয়া যায়, তাই নাকি পাওয়া যায়।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা যখন ওই গাছটি পরখ করছিলেন, দলের এক সদস্য দূরে একটি ছোট্ট পাহাড় দেখতে পান। পাহাড়ের মাটি পরখ করে দেখেন, বাকি এলাকার তুলনায় তা অনেকটাই আলাদা। সেই মাটি কিছুটা খনন করতেই বেরিয়ে আসে চুনাপাথরের স্তর।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি দেশে ফিরে রিপোর্ট তৈরি করে। তাতে লেখা হয়, ওই পাহাড়ে তেমন কিছুই মেলেনি। সম্ভবত কোনও সমাধি রয়েছে। একটি গাছ কেন একা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা নিয়ে এক লাইনও লেখেননি দলের সদস্যেরা।
২৫ বছর পর ১৯৮৮ সালে স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দা সাভাক ইলডিজ় গাছের নীচ থেকে দু’টি মূর্তি উদ্ধার করেন। গ্রামবাসীরা তাঁকে সেই মূর্তি দু’টি বিক্রি করার পরামর্শ দেন। ইলডিজ় নাছোড়। তিনি সেগুলি সানলিউরফা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে নিয়ে যান।
জাদুঘরের কর্মীরা মূর্তি পরখ করে জানান, সেটি মোটেও বিশেষ কিছু নয়। ইলডিজ় চাইলে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তিনি জানতেনও না, আসলে কী উদ্ধার করেছেন তিনি।
আরও ছ’বছর পর ১৯৯৪ সালে বার্লিনের জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রে সানলিউরফা নিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক দলের সেই রিপোর্টটি পড়েন স্কিমিড। গোটা এলাকায় একটিই গাছ— অদ্ভুত ঠেকে স্কিমিডের। সিদ্ধান্ত নেন, শীঘ্রই সেখানে যাবেন।
সাত দিনের মাথায় সানলিউরফা জাদুঘরে পৌঁছে যান ৪১ বছরের স্কিমিড। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেই গাছের কাছে যান। বুঝতে পারেন, ওই গাছের গর্ভে রয়েছে অনেক গোপন ইতিহাস। মানবসভ্যতা, বিশ্বাস, ধর্মের ইতিহাস।
এক বছর পর সেই অঞ্চলে খনন কাজ শুরু করান স্কিমিড। ক্রমে তাঁর সঙ্গে ‘কথা বলে’ ১১ হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস। খননের পর প্রথম ধাপে সেখানে দেখা যায় প্রায় ২০টি গোল গোল চক্র। বিশাল লম্বা শিলাস্তম্ভ সেই চক্র তৈরি করেছে।
পরের ধাপ খননের পর স্কিমিড ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জের সঙ্গে মিল খুঁজে পান। সব ক’টি শিলার আকৃতি ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো। দেখে আপাত ভাবে মনে হবে হাত ছড়িয়ে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক-একটির উচ্চতা ৫.৪ মিটার।
এক-একটি শিলাখণ্ডের ওজন ১৬ টন। স্কিমিডের মনে প্রশ্ন ওঠে, ওই পাথরগুলি কে সেখানে নিয়ে এসেছেন? কী ভাবে? ইতিহাস ঘেঁটে স্কিমিড জানতে পারেন, খ্রিস্ট জন্মের ৩০০০ বছর আগে সৌধ নির্মাণের জন্য পাথর বহন করে নিয়ে আসত গাধার দল।
কিন্তু তা বলে খ্রিস্ট জন্মের ৮০০০ বছর আগে পশুকে বশ করে মালবহন কি সম্ভব ছিল? কারণ ওই শিলাখণ্ড অত বছর আগেই তৈরি হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছিলেন স্কিমিড। ফলে তাঁর মনে প্রশ্ন ঘুরতেই থাকে। শুধু পাথর আনলে হবে না, সেগুলিকে দাঁড় করাতে হবে। যন্ত্র ছাড়া সেটাই বা কী ভাবে সম্ভব?
স্কিমিড ওই ‘টি’ আকারের শিলা এবং সংলগ্ন অঞ্চল পরখ করে একটি বিষয় বুঝতে পারেন যে, সেখানে কখনওই কোনও মানুষের বাস ছিল না। একটি ঘরেরও চিহ্ন মেলেনি সেখানে। রান্নাবান্না করার উনুনের অস্তিত্বও মেলেনি।
ওই এলাকার আশপাশে কোনও জলাশয় বা নদীরও হদিস মেলেনি। মানবসভ্যতা গড়ে ওঠার জন্য যা জরুরি। ওই শিলাখণ্ডগুলি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছিল একটি জলাশয়।
খনন করতে করতে যত গভীরে গিয়েছিল স্কিমিডের দলবল, ততই অবাক হয়েছিল। শিলাখণ্ডের উপর অদ্ভুত কিছু ছবি আঁকা ছিল। এতটাই নিখুঁত ছিল সে সব ছবি যে, দেখে অবাক হয়েছিলেন স্কিমিড।
আরও একটি পাথরের তৈরি টেবিল স্কিমিড আবিষ্কার করেন। তার উপর খোদাই করা ছিল একটি গাছ আর এক বিবস্ত্র নারীমূর্তি। এই নারীমূর্তিই স্কিমিড দেখেছিলেন সানলিউরফার জাদুঘরে।
এর পর মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে একটি মূর্তির মাথা দেখতে পান খননকারীরা। তত ক্ষণে সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। ওই অবস্থায় সেটিকে রেখে স্কিমিড এবং দলের সকলে বাড়ি যান। পরের দিন গিয়ে আর সেই মূর্তির খোঁজ মেলেনি। চুরি হয়ে গিয়েছিল। পরে স্কিমিড বুঝেছিলেন, দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের কারণেই এমনটা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছিল, এটাই পৃথিবীর প্রথম ধর্মস্থান কি না। যার উদ্ভব খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ৮,২০০ বছর আগে। স্কিমিড অবশ্য তা মানেননি। তিনি জানান, সে সময় ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। তা হলে এগুলি কী?
স্কিমিডের দাবি, আদি পুরুষ আদম আর ইভ নাকি গোবেলক্লিটেপের ‘মন্দিরে’ বাস করতেন। ওটাই ছিল ‘ইডেন উদ্যান’। আর আপেল নয়, তারা নাকি খেয়েছিলেন মালবেরি, যেই গাছ খননের আগে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল ওই এলাকায়। ওই গ্লোবেলক্লিটেপ থেকেই নাকি সূচনা মানবসভ্যতার। যদিও এই নিয়ে রয়েছে অসংখ্য মতবিরোধ।