উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। দু’দেশই আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের হুমকি দিয়ে চলেছে একে অপরকে। উত্তর কোরিয়া তার প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।
গত জানুয়ারিতে দুই কোরীয় বিশেষজ্ঞ তথা পর্যবেক্ষক রবার্ট কার্লিন এবং সিগফ্রাইড হেকার আভাস দিয়েছিলেন যে, কিম জং উন দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেই সময়ে এই সাবধানবাণী অতিরঞ্জিত মনে হলেও বর্তমানে অনেকেই মনে করছেন, সেই দিকেই এগোচ্ছে দুই দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি।
উত্তর কোরিয়ার সর্বাধিনায়ক জানুয়ারিতেই ঘোষণা করেছিলেন যে, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে জোট বাঁধার সমস্ত প্রচেষ্টা ত্যাগ করছেন তাঁরা। পড়শি দেশকেই যে প্রাথমিক এবং প্রধান শত্রু বলে গণ্য করছেন কিম, স্পষ্ট করেছিলেন সেটাও।
গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়ার আকাশসীমায় দক্ষিণ কোরিয়ার ড্রোনের অনুপ্রবেশ ঘিরে সংঘাতের আবহ তৈরির পর থেকেই সিওল ও পিয়াংইয়ংয়ের মধ্যে সম্মুখসমরের আশঙ্কা করছে সংবাদমাধ্যমের একাংশ।
উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের সরকার বুধবারই দাবি তুলেছে প্রায় ১৪ লক্ষ যুবক যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে প্রস্তুত। উত্তর কোরিয়ার সব পুরুষকেই বাধ্যতামূলক ভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হয়।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা ‘দ্য সেন্ট্রাল নিউজ় এজেন্সি’র দাবি, সংঘাতের পরিস্থিতিতে সে দেশের তরুণ-তরুণীরা সেনায় যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
এপ্রিল মাসে সে দেশের সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনের সময়ে কিম জানিয়েছিলেন, শত্রুবাহিনী উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে কোনও রকম দ্বিধা না রেখেই তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া পিয়ংইয়ংয়ের সীমান্ত এলাকা ড্রোন পাঠানোর জন্য সিওলকে অভিযুক্ত করে। দক্ষিণ কোরিয়ার তরফে ইতিমধ্যেই ড্রোন অনুপ্রবেশের অভিযোগ খারিজ করা হয়েছে। যদিও তাতে কর্ণপাত করেনি পিয়ংইয়ং।
সীমান্ত জুড়ে পিয়ংইয়ং-বিরোধী প্রচারপত্র-সহ ড্রোন ওড়ানোর অভিযোগের জবাব না মেলায় পাল্টা আক্রমণ চালায় কিম সরকার। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, মঙ্গলবার কিমের বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী একটি সড়ক এবং সেতু উড়িয়ে দেয়।
এই ঘটনার আগেই দক্ষিণ কোরিয়াকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন কিম জংয়ের বোন কিম ইয়ো জং। দক্ষিণ কোরিয়ার ড্রোন উত্তর কোরিয়ার আকাশে আবার প্রবেশ করলে তার ফল হবে ভয়ঙ্কর। এই মর্মেই কিম ইয়ো সতর্ক করেছেন সিওলকে।
উত্তর কোরিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ইয়ো জানান, আত্মরক্ষার জন্য তাঁর দেশ সব সময়ই প্রস্তুত। আত্মপ্রত্যয়ের একই সুর শোনা গিয়েছিল কিমের গলায়ও।
উত্তর কোরিয়ার সংবাদ সংস্থাকে উদ্ধৃত করে বিদেশি সংবাদমাধ্যগুলি দাবি তুলেছে, উত্তর কোরিয়া চাইলে দক্ষিণ কোরিয়ার অস্তিত্ব পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে পারে।
সাম্প্রতিককালে চিন এবং রাশিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার শক্তিশালী সম্পর্কের কথাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। যা এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও জটিল করে তুলেছে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
আমেরিকার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে। ২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনই সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু হয়েছিল আমেরিকার ও উত্তর কোরিয়ার। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করেই কূটনৈতিক স্তরে সম্পর্কের এই পতন।
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার ভরিয়ে তোলায় সবচেয়ে বেশি ইন্ধন জোগাচ্ছে রাশিয়া। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি অনুযায়ী, রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করে কোরিয়াকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ইঙ্গিত দিয়েছে।
রাশিয়া যদি যুদ্ধের মুখে পড়ে তবে নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়াবে উত্তর কোরিয়া। পুতিনের সঙ্গে সামরিক চুক্তির পর এমনটাই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন কিম। উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে নতুন চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই কড়া প্রতিক্রিয়া জানান দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
তিনি জানান, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের আবেদন সত্ত্বেও তাদের সামরিক সহযোগিতা করেনি দক্ষিণ কোরিয়া। তা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়াকে মস্কো কাছে টেনে নেওয়ার ঘটনায় সিওল জানিয়েছিল, ভবিষ্যতে রাশিয়ার পক্ষে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা পুতিনের বিবেচনা করা উচিত।
উত্তরকে সামাল দিতে ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকছে দক্ষিণ কোরিয়া। গত ২৫ এপ্রিল এক সরকারি সফরে আমেরিকা যান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়োল। ওয়াশিংটনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেন তাঁরা।
সেই চুক্তির পরে উত্তর কোরিয়া দুই দেশের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা শুরু করেছে। এই দুই দেশ পরমাণু যুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উত্তর কোরিয়ার দুই সামরিক বাহিনীর শীর্ষকর্তার। সেই সময় কিমের সরকার হুমকি দেয়, সর্বোচ্চ নেতা কিম জং নির্দেশ দিলেই শত্রুদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে তৈরি উত্তর কোরিয়া।
উত্তর কোরিয়া ২০২২ সালে ৩০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। এ সব পরীক্ষার মধ্যে দূরপাল্লার কিছু ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলি আমেরিকার মাটিতেও আঘাত হানতে পারে। ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের তথ্য অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ২০টি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী।
বর্তমান সময়ে এক দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইজ়রায়েল-হামাস সংঘর্ষে উত্তপ্ত বিশ্ব। এই পরিস্থিতিতে কিমের সরকারের এই বিবৃতি নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সমর বিশেষজ্ঞেরা। কিম বরাবরই ঘোষণা করে এসেছেন তাঁর সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।