আবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হলেন নীতীশ কুমার। এই নিয়ে অষ্টম বার পটনার মসনদে বসলেন নীতীশ। তবে ‘পার্টনার’ বদলে। জোট বদলে। বিজেপির হাত ছেড়ে আরজেডির হাত ধরেছেন নীতীশ। যার প্রেক্ষিতে বিজেপির বক্তব্য, উনি ‘স্বভাবগত বিশ্বাসঘাতক’। রাজনৈতিক সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ততা ধাতে নেই নীতীশের। অভিযোগটি কি সত্যি?
আসলে নীতীশ কুমারের সঙ্গী কে হবেন? তা নিয়ে আলোচনা হলেও, বরাবর বিচার্য ছিল একটিই বিষয়— ‘পার্টনার’ যেই হোন, পটনার গদিতে কি তিনিই বসছেন? জবাব ছিল, বসছেন। তিনি নিজে না চাইলে সম্ভবত সেখান থেকে তাঁকে সরানোও মুশকিল! বা ‘ডন’ ফিল্মের কায়দায় এ-ও বলা যেতে পারে, ‘মুশকিল হি নহি, না-মুমকিন’। কারণ গত ১৭ বছরের ইতিহাস তা-ই বলছে।
২০০০ সালে নীতীশ প্রথম বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন। তবে রাজনীতিতে রয়েছেন ১৯৮৫ সাল থেকেই। রাজনীতির পেশাদার হিসাবে গত ৩৭ বছরের জীবনে তিনি বহু বার বদলেছেন রাজনৈতিক সঙ্গী। বলা যায়, সঙ্গী বদলের নীতি কখনওই বদলাননি নীতীশ।
এই নীতিতেই প্রতিদ্বন্দ্বী লালুর হাত ধরতে যেমন থমকাননি নীতীশ, তেমনই পুরনো বন্ধু বিজেপির হাত ছাড়তেও বাধেনি তাঁর।
অদ্ভুত ভাবে প্রত্যেক বার সঙ্গী বদলের পর পাশা উল্টেছে। আর ঘুরেফিরে তা নীতীশের পক্ষেই গিয়েছে। সে মুখ্যমন্ত্রিত্ব হোক, নির্বাচনে নিজের জয় হোক বা দলের জয়।
খুব পুরনো কথা নয়। ২০১৪ সালেই পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটে, যা নীতীশের ‘পার্টনার বদল নীতি’-র উদাহরণ দেয়।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তখন দেশজুড়ে বড় মাপের প্রচারে নেমেছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী প্রধান মুখ। মোদীর এই উত্তরণ নিয়ে অসন্তোষ জানান এনডিএ-তে থাকা নীতীশ। ভেঙে দেন বিজেপির সঙ্গে জোট।
বিধানসভায় বিজেপির সঙ্গে সরকার চললেও লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের সঙ্গে জোট বেধে লড়েন নীতীশ। কিন্তু হেরে যান। মাত্র দু’টি আসন পেয়েছিল সেই জোট। কিন্তু তার পরই শুরু হয় নীতীশের আসল পরীক্ষা।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে খারাপ ফল করার জন্য মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেন নীতীশ। প্রশ্নের মুখে পড়ে বিহারের জনতা দল ইউনাইটেড এবং বিজেপির জোট সরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বলা হয় নীতীশকে।
বিপাকে পড়ে সেই সময় লালুপ্রসাদের হাত ধরেন নীতীশ। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সমর্থনেই বিহার বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করে জনতা দল ইউনাইটেড। বিপদ বুঝেই নতুন বন্ধু পাতিয়ে নেন নীতীশ।
অথচ এর আগে ২০০৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই আরজেডির সরকার ফেলতেই বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়েছিলেন নীতীশ। জিতেওছিলেন সে বার। জয়ী হয়েই দ্বিতীয় বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন নীতীশ।
পরে ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন, ২০১০ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও নীতীশ-বিজেপির সেই জোট সফল হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের বিধানসভা ভোটের আগে হয় ছন্দপতন। জোট বদল।
লালুকে সঙ্গী করে ২০১৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করেন নীতীশ। সরকার গঠন করে লালু-নীতীশ এবং রামবিলাস পাসোয়ানের দলের মিলে। নতুন জোটে নতুন সরকারে ফের নীতীশ হন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী।
বস্তুত, আরজেডি আর বিজেপির মধ্যে নীতীশের এই বার বার রং বদল, জোট বদল চলতেই থেকেছে। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে।
জনতা দলের প্রার্থী হয়ে ১৯৮৫ সালে প্রথম বিহারের বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন নীতীশ। ১৯৮৯ সালে বিহারের বিধানসভায় বিরোধী নেতা হিসাবে তিনি লালুকে সমর্থন করেন। অথচ ১৯৯৬ সালে প্রথম বার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগে বিজেপির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন নীতীশ। সাংসদ হয়ে নীতীশ রেলমন্ত্রী হন। পরে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী এবং ভূতল পরিবহনমন্ত্রীও হন।
১৯৯৭ সালে আরজেডি গঠন করেছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে আরজেডিকে হারিয়ে দেন নীতীশ। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হন নীতীশ। ফের রেল মন্ত্রক, কৃষি মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে।
শেষ বার নীতীশ সঙ্গী বদলেছিলেন ২০১৭ সালে। বিহারের সরকার তখন ভেঙে যেতে বসেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। নীতীশ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ইস্তফা দেন। ২৪ ঘণ্টা পরে বিজেপির সমর্থনে নতুন সরকার গড়ে আবার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। তিন বছর পর এই বিজেপির হাত ধরেই ফের বিহারে সরকার গড়ে নীতীশের জেডিইউ। ২০২০ সালেও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন নীতীশই।
দু’বছর পর ২০২২ সালে সেই একই জায়গায় নীতীশ। আবার বিজেপির হাত ছেড়েছেন। বিহারের রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে ইস্তফা দিয়েছেন। আরজেডি-সহ আরও অনেক দলের সঙ্গে জোট গড়ে এ বার অষ্টম বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথও নিলেন নীতীশ। এখন দেখার এই সঙ্গীর প্রতি কত দিন বিশ্বস্ত থাকেন নীতীশ।