হরিদেবপুরের অয়ন মণ্ডল খুনের ঘটনা সাড়া ফেলে দিয়েছে বাংলায়। দ্বাদশীর দিন, দুর্গাপুজোর রেশ তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি অনেকেই, উদ্ধার হয় হরিদেবপুরের যুবকের দেহ। তদন্তে নেমে একের পর এক রহস্য জট পাকিয়ে ওঠে পুলিশের সামনে। ধীরে ধীরে তার অনেক জটই খুলেছে। তবে সব নয়।
অয়নের খুনের তদন্ত করতে গিয়ে ত্রিকোণ প্রেমের ইঙ্গিত পেয়েছে পুলিশ। তাদের দাবি, বান্ধবী এবং বান্ধবীর মা, দু'জনের সঙ্গেই অয়নের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই জটিলতা থেকেই খুন হতে হয়েছে অয়নকে।
সংবাদমাধ্যমে প্রথমে অয়নের বাবাও ত্রিকোণ প্রেমের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পরে তিনি আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে জানান, পুলিশের ‘চাপ’-এর মুখে মা-মেয়ের সঙ্গে অয়নের সম্পর্কের কথা বলেছিলেন।
অয়নের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে শক্ত ও ভোঁতা কোনও জিনিস দিয়ে তাঁর মাথা এবং সারা শরীরে আঘাত করা হয়েছে। তার ফলেই মৃত্যু। যে ইট দিয়ে তাঁকে মারা হয়েছিল, তা-ও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
ত্রিকোণ প্রেমের জটিলতা থেকে অপরাধ নতুন নয়। অয়নের আগেও এমন নৃশংস খুনের নজির রয়েছে এ দেশেই। ২০০৮ সালের নীরজ গ্রোভার হত্যার ঘটনাও ছিল শিউরে ওঠার মতো।
মুম্বইয়ের এক প্রোডাকশন হাউজে কাজ করতেন নীরজ। তাঁর মৃত্যুর পর তদন্তে নেমে পুলিশ ত্রিকোণ প্রেমের ইঙ্গিত পায়। ধীরে ধীরে খোলে রহস্যের জট।
টেলিভিশন কর্মী নীরজকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয় এক দক্ষিণী অভিনেত্রী এবং তাঁর প্রেমিককে। খুন এবং প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। যে ভাবে খুন এবং সেই অপরাধ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন দু’জন, তা যে কোনও বলিউডের কাহিনিকেও হার মানাবে।
দক্ষিণী চলচ্চিত্র জগতে সবেমাত্র পা রেখেছিলেন মারিয়া সুসাইরাজ। তাঁর প্রেমিকের নাম এমিল জেরোম ম্যাথিউ। মারিয়াকে টেলিভিশন দুনিয়ায় পরিচিতি তৈরি করতে সাহায্য করছিলেন নীরজ। সেই সূত্রে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। যা মোটেই ভাল চোখে দেখেননি প্রেমিক ম্যাথিউ।
মুম্বইতে নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন মারিয়া। নীরজ তাতেও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অভিযোগ, তাঁদের মধ্যে গোপন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এমনকি নীরজের বাড়িতেও মারিয়াকে থাকতে দেখা গিয়েছিল বেশ কিছু দিন।
২০০৮ সালের ৬ মে মারিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন নীরজ। আর ফেরেননি। পুলিশ মারিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অন্তত দশ দিন তিনি মিথ্যা কথা বলে তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করেছিলেন বলে অভিযোগ। পরে সত্যিটা প্রকাশ্যে আসে।
জানা যায়, মারিয়ার সঙ্গে দেখা করতে সে দিন রাতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন নীরজ। সেই সময় ম্যাথিউয়ের ফোন আসে। মারিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি নেপথ্যে পুরুষকণ্ঠ (নীরজের কণ্ঠ) শুনতে পান।
মারিয়া তাঁর প্রেমিককে জানান, নীরজ কিছু ক্ষণের জন্য তাঁর বাড়িতে এসেছেন। কোনও ভাবেই যেন নীরজ তাঁর বাড়িতে রাত না কাটান, সে বিষয়ে ফোনেই মারিয়াকে সাবধান করেন ম্যাথিউ।
মারিয়াকে না জানিয়ে পরের দিন সকালেই কোচি থেকে মুম্বই উড়ে আসেন ম্যাথিউ। সটান হাজির হন প্রেমিকার বাড়ি। মারিয়ার শোওয়ার ঘরে তিনি নীরজকে দেখতে পান বলে অভিযোগ।
প্রেমিকার গোপন সম্পর্ক হাতেনাতে ধরে মাথায় খুন চেপে যায় ম্যাথিউয়ের। তুমুল বচসা হয় নীরজের সঙ্গে। রাগের মাথায় রান্নাঘর থেকে ছুরি এনে তা দিয়ে ম্যাথিউ কুপিয়ে খুন করেন নীরজকে।
খুন ধামাচাপা দিতে প্রেমিককে সাহায্য করেছিলেন মারিয়া। তাঁরা দু’জন মিলে নীরজের মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে কাটেন।
টুকরো করা মৃতদেহ একটি ব্যাগে ভরে গাড়ি করে নিয়ে যান দূরের এক জঙ্গল এলাকায়। ব্যাগে পেট্রল ঢেলে সেখানেই আগুন ধরিয়ে দেন তাঁরা।
এই ঘটনা সাড়া ফেলে দিয়েছিল মুম্বইতে। খবর রটেছিল, নীরজের দেহ নাকি অন্তত ৩০০ টুকরো করা হয়। কিন্তু এর কোনও প্রমাণ মেলেনি।
মারিয়া খুনের প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে তিন বছর জেল খাটেন। ম্যাথিউকে ১৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। এ ছাড়া দু’জনকেই ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।
ত্রিকোণ প্রেমের রসায়ন থেকে যে জটিলতা দানা বাঁধে, তার জেরেই মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল টেলিভিশন কর্মী নীরজের। হরিদেবপুরের অয়ন মণ্ডলের ঘটনা মনে করাচ্ছে তাঁর মৃত্যুও।