Sea monsters

সাত মাথা, প্রাচীন বিশ্বে কল্পিত সমুদ্রদানবদের মধ্যে বৃহত্তম! লেভিয়াথান কি শুধুই কল্পনা? কী বলছে প্রাচীন গ্রন্থ?

লেভিয়াথানের মতো এক বৃহদাকার প্রাণীর কল্পনার নেপথ্যে কি বাস্তবের কোনও ছায়া ছিল? সে কি কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী বা ডাইনোসর?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ ১৪:৩৬
Share:
০১ ১৪
sea monster

সমুদ্রের রহস্য মানুষকে চিরকালই আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে সমুদ্রের নীচে বাসরত জীবদের নিয়ে কৌতূহল এক দিকে যেমন বহু অজানা অভিযানে নিয়ে গিয়েছে, তেমনই নেহাত ডাঙায় বসেও অসম্ভব জীবদের কল্পনা করেছে মানুষ। রূপকথার মৎস্যকন্যা, গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত সাইরেন, উত্তর ইউরোপের কিংবদন্তির দানবিক ক্রাকেন থেকে শুরু করে আধুনিক বিশ্বে আমেরিকান সাহিত্যিক হাওয়ার্ড ফিলিপ লাভক্র্যাফট কল্পিত থুলু বা ডাগোন— সকলেই সামুদ্রিক। তবে, প্রাচীন দুনিয়ায় কল্পিত সমুদ্রদানবদের মধ্যে সব থেকে বৃহৎ হল লেভিয়াথান। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে জ্ঞানদীপ্তির কালের ইউরোপে, এমনকি আধুনিক সাহিত্যেও বার বার উঠে এসেছে লেভিয়াথানের প্রসঙ্গ। কখনও কিংবদন্তি হিসাবে, কখনও বা রূপকার্থে।

০২ ১৪
sea monster

লেভিয়াথান আসলে এক সমুদ্রসর্প। তার আকৃতি বিশাল। ইহুদি পুরাণে জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের তিন দানবের কথা রয়েছে। আকাশে জ়িজ়, ডাঙায় বেহেমোথ আর জলে লেভিয়াথান। পুরাণের ভাষ্যকারেরা পরবর্তী কালে এদের ‘কেওস মনস্টার’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ, আদিতে বিশ্ব এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। সেখানে এই সব দানব দাপটের সঙ্গে রাজত্ব চালাত। এদের দমন করেই ঈশ্বর পৃথিবীতে নিয়মের রাজত্ব বা শৃঙ্খলা স্থাপন করেন। লেভিয়াথান সেই বিশৃঙ্খল জগতের অন্যতম খলনায়ক।

Advertisement
০৩ ১৪

হিব্রু বাইবেলে ছয় জায়গায় লেভিয়াথানের উল্লেখ রয়েছে বলে জানা যায়। এ-ও জানা যায় যে, জিহোবা বা ঈশ্বর তাকে হত্যা করেছিলেন। খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব লেভিয়াথানকে সাতটি ভয়ঙ্কর পাপের অন্যতম ‘ঈর্ষা’র প্রতিরূপ বলে মনে করে। তবে হিব্রু বাইবেলের ‘বুক অফ জ়োব’-এ তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে তাকে অগ্নিভক্ষণকারী বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। আবার একই বাইবেলের ‘বুক অফ আইজায়া’-তে লেভিয়াথানকে সৃষ্টি করার জন্য ঈশ্বরের স্তুতি করা হয়েছে এবং মহাপ্রলয়ের কালে তাকে ধ্বংস করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

০৪ ১৪

লক্ষণীয়, সেমিটিক কিংবদন্তির অনেক জায়গাতেই ‘মহাসর্প’-এর উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন মিশরের কিংবদন্তিতে আপেপ নামে এক সমুদ্রসর্পের সঙ্গে সূর্যদেবতা রা-এর সংঘাতের কথা জানা যায়। তবে পরবর্তী কালের ইহুদি পুরাণে লেভিয়াথানের বর্ণনা অনেকটাই ড্রাগনের মতো। ‘বুক অফ ইনোখ’-এ তাকে ভূগর্ভস্থ সমুদ্রে বাসরত এক রাক্ষসী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

০৫ ১৪

ইহুদিদের আর এক ধর্মগ্রন্থ ‘তালমুদ’-এ বর্ণিত হয়েছে, ভবিষ্যতে লেভিয়াথানকে বধ করা হবে এবং তার মাংস তাঁদেরই খেতে দেওয়া হবে, যাঁরা প্রকৃত অর্থে ধর্মের পথে রয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ‘তালমুদ’ এ কথাও জানাচ্ছে যে, লেভিয়াথানের চামড়া দিয়ে তৈরি তাঁবুর ভিতরে সেই মহাভোজ সম্পন্ন হবে। হিব্রু ক্যানানাইট বাইবেলের গীতসংহিতায় লেভিয়াথানের সাতটি মাথার উল্লেখ রয়েছে।

০৬ ১৪

ইহুদি কাবালাপন্থীদের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ‘জ়োহার’-এ কিন্তু লেভিয়াথানকে আলোকপ্রাপ্তির প্রতীক হিসাবে দেখা হয়েছে এবং তার মাংসভক্ষণের বিষয়টিকে সম্যক জ্ঞানলাভের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

০৭ ১৪

খ্রিস্টধর্মে কিন্তু লেভিয়াথানের ধারণা সবিশেষ সুবিধার নয়। তাকে অনেক সময়েই শয়তানের সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। সে ঈশ্বর-সৃষ্ট জীবেদের ভক্ষণ করে এবং মহাবিশৃঙ্খলার কালে বিস্তর গোলমালের হোতা হিসাবে কাজ করে। গ্রিক বাইবেলে উল্লিখিত ‘কেওস মনস্টার’দের সঙ্গে ঈশ্বরের দ্বন্দ্ব মূলত অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির লড়াই হিসাবে বর্ণিত। সে দিক থেকে দেখলে লেভিয়াথান শয়তানের প্রতিরূপ হতেই পারে। অনেক সময়েই তার বর্ণনা ড্রাগনের মতো। উল্লেখ্য, খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যে ড্রাগন অশুভ শক্তির ধারক হিসাবেই বিবেচিত।

০৮ ১৪

মধ্যযুগে শয়তানের উপাসক সম্প্রদায় আবার বিশ্ব যে চারটি মূল উপাদানে নির্মিত (আগুন, বাতাস, জল ও মাটি), তার মধ্যে জলের অধীশ্বর হিসাবে তাকে গণ্য করতে শুরু করে। ‘স্যাটানিক বাইবেল’-এ তাকে পশ্চিম দিকের প্রতীক হিসাবেও দেখা হয়েছে। এই বিন্দু থেকে বিচার করলে লেভিয়াথান অবশ্যই কোনও অনিষ্টকারী জীব নয়।

০৯ ১৪

গ্নস্টিক চিন্তাধারায় লেভিয়াথান এমনই এক মহাসর্প, যে তার নিজের লেজকেই ভক্ষণ করে। তাকে ঈশ্বরের রাজত্ব এবং মানবিক জগতের সীমানা নির্দেশকারী হিসাবেও দেখা হয়।

১০ ১৪

ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তির কালে লেভিয়াথানের অর্থ ও ব্যঞ্জনা বদলায়। তার গা থেকে ধর্মীয় ব্যাখ্যার আবরণ খসে পড়ে এবং এক ধরনের ‘সেকুলার’ ব্যাখ্যা প্রযোজ্য হতে শুরু করে। সপ্তদশ শতকে সমুদ্রাভিযানের যুগ শুরু হলে যে কোনও সমুদ্রদানবকেই লেভিয়াথান বলে উল্লেখ করতেন নাবিকেরা।

১১ ১৪

১৬৫১ সালে ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস তাঁর সামাজিক চুক্তি মতবাদ সংক্রান্ত গ্রন্থের নাম রাখেন ‘লেভিয়াথান’। পরবর্তী কালে অভিধান লেখকেরা ব্যাখ্যা করেন, হবস ‘লেভিয়াথান’কে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁরা দেখান, হবস হিব্রু ‘লাভাহ্’ শব্দটিকে ‘লেভিয়াথান’-এর উৎস হিসাবে ব্যবহার করেন। এই শব্দটির অর্থ— ‘জোট বাঁধা’ বা ‘সংযুক্ত হওয়া’। আভিধানিকদের মতে, হবস সার্বভৌমের সঙ্গে জনগণের চুক্তির দ্বারা আবদ্ধ হওয়ার কথাই বলতে চেয়েছিলেন।

১২ ১৪

ইংরেজ কবি মিলটন তাঁর ‘প্যারাডাইস লস্ট’ কাব্যে শয়তানের আকারের বর্ণনায় তাকে লেভিয়াথানের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ১৮০৪ সালে আর এক ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক তাঁর ‘জেরুসালেম’-এ বেহেমোথ ও লেভিয়াথানের উল্লেখ করেছিলেন। তবে এই উল্লেখগুলি ছিল একান্ত ভাবেই খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের অনুষঙ্গবাহী। ১৮৫১ সালে প্রকাশিত ‘মবি-ডিক’ উপন্যাসে আমেরিকান সাহিত্যিক হারম্যান মেলভিল তিমিকে লেভিয়াথানের প্রতিরূপ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

১৩ ১৪

এখন প্রশ্ন হল, লেভিয়াথানের মতো এক বৃহদাকার প্রাণীর কল্পনার নেপথ্যে কি বাস্তবের কোনও ছায়া ছিল? আমেরিকান শিল্পী, চিত্রনাট্যকার এবং লেখক ব্রায়ান গোডাওয়া দীর্ঘ কাল ধরে বাইবেলে উল্লিখিত ঘটনা ও কাল্পনিক জীবেদের বিষয়ে বই লিখে চলেছেন। ব্রায়ানের অন্যতম উদ্দেশ্য সেই সব ঘটনা ও জীবেদের কল্পনার নেপথ্যের বাস্তব ভিত্তি কিছু রয়েছে কি না, খুঁজে দেখা। তাঁর ‘লেভিয়াথান অ্যান্ড বেহেমোথ’ গ্রন্থে প্রশ্ন তুলেছেন, সে কি কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী বা ডাইনোসর? মানুষ ও ডাইনোসরদের একই সময়ে অবস্থানের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। আবার লেভিয়াথানের বর্ণনাও কোনও প্রাগৈতিহাসিক জীবের সঙ্গে মেলে না।

১৪ ১৪

ব্রায়ানের মতে, সমুদ্র বাইবেলে বার বার উল্লিখিত হয়েছে মূলত তার দুর্লঙ্ঘ্য চরিত্রের কারণে। ঈশ্বরের নির্দেশে মোজেসের লোহিত সাগর পার হওয়া আসলে জলজগতের উপরে মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথাই বলে। সে দিক থেকে দেখলে, লেভিয়াথানের মতো কাল্পনিক সমুদ্রদানবকে দমন করার বিষয়টিও আদপে জলজগতের উপর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই বোঝায়।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement