‘ডাইনি’ শব্দটি শুনলেই যেন বুক থেকে রক্ত উবে যায়। বিশ্বের সব সভ্যতাতেই কোনও না কোনও ভাবে রয়ে গিয়েছে ডাইনিদের অস্তিত্ব। কোথাও উপজাতিদের মধ্যে, কোথাও আবার সমাজের মূল ধারাতেই রয়েছে ডাইনিবিদ্যার চর্চা। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত বহমান থেকেছে এই চর্চা। মধ্যযুগে এবং তার পরবর্তী কালে ইউরোপে হাজার হাজার মানুষকে ‘ডাইনি’ অভিযোগে পুড়িয়ে মারে তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চ। তা সত্ত্বেও টিকে থাকে ডাইনিবিদ্যার চর্চা বা উইচক্র্যাফট। আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে, একদা যা ছিল অতি গর্হিত অপরাধ, আজ পশ্চিমি দুনিয়ায় সেই উইচক্র্যাফটই হয়ে দাঁড়িয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
ইউরোপীয় উইচক্র্যাফটের ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে দেখা যাবে, তার জন্ম সুদূর অতীতে। প্রাগৈতিহাসিক কালে। প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনার পাশাপাশি মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তিকেও আয়ত্ত করতে চায়। আর সেখান থেকেই জন্ম হয় এই বিদ্যার।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাঁরা এক সময়ে ‘উইচ’ বা ‘ডাইনি’ বলে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন অ্যালকেমি বা অন্য কোনও বিষয়ের সন্ধানী। সেই সব বিষয়ের মধ্যে অমরত্ব লাভের উপায়, অনন্ত যৌবনের অধিকারী হওয়ার পদ্ধতি থেকে শুরু করে এমন কিছু বিষয় ছিল, যা চিকিৎসার কাজেও ব্যবহৃত হত। (সঙ্গের ছবিটি ১৭৭১ সালে ইংরেজ চিত্রকর জোসেফ রাইটের আঁকা অ্যালকেমি গবেষণাগারের)
উইচ বা ডাইনিবিদ্যার চর্চাকারীদের ব্যাপারে সমাজের বেশির ভাগ মানুষই বিচিত্র মনোভাব পোষণ করতেন। মধ্যযুগের ইউরোপের গ্রামজীবনে মহামারি, পানীয় জলে দূষণ বা এই জাতীয় কোনও অঘটন ঘটলে শুরু হত ‘ডাইনি’ খোঁজার কাজ। একটি স্তরে ডাইনি খোঁজা বা ‘উইচ হান্ট’ সামাজিক ব্যাপার হলেও পরে তাতে ঢুকে পড়ে ক্যাথলিক চার্চ।
ডাইনিবিদ্যার চর্চাকে ‘খ্রিস্টধর্ম বিরোধী’ বা এক কথায় ‘ধর্মদ্রোহ’ বলে চিহ্নিত করে অগণিত মানুষকে হত্যা করা শুরু হয়। যাঁদের ডাইনি বা উইচ বলে হত্যা করা হচ্ছিল, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ মানুষ। ডাইনিবিদ্যা চর্চার সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। তবু রোমান চার্চ নিজের আধিপত্য কায়েম রাখতে সাধারণ মানুষের মনে ‘ডাইনি-ভীতি’ জাগিয়ে রাখে। ত্রয়োদশ শতকে গির্জার তরফে ডাইনি বিরোধী অভিযান তুঙ্গে ওঠে।
অন্য দিকে যাঁরা প্রকৃতই ডাইনিবিদ্যার চর্চা করতেন, তাঁদের একটা বড় অংশই গির্জার রোষ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলার উপায় জানতেন। আবার সমাজের ক্ষমতাবান মানুষদের অনেকেই তাঁদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কাজ করতেন। ফলে সহজে গির্জা তাঁদের ঘাঁটাতে পারত না।
কিন্তু কেন এই সব উদ্ভট বিদ্যার চর্চাকারীদের সঙ্গে নিজেদের জড়াতেন অভিজাত থেকে শুরু করে রাজা-রাজড়ারাও? আসলে ‘ডাইনিবিদ্যা’ বলে এক পঙক্তিতে সকলকে বসিয়ে দিলেও এই সব অদ্ভুত বিদ্যার চর্চাকারীরা সবাই সমগোত্রীয় ছিলেন না। তাঁদের একাংশ চর্চা করতেন ‘উইক্কা’ নামের এক প্রাচীন দর্শনের। কেউ কেউ ছিলেন গ্নস্টিক দর্শনে (ধ্রুপদী গ্রিক যুগ থেকে চলে আসা এক বিশেষ জ্ঞানচর্চার ধারা) বিশ্বাসী। অনেকে চর্চা করতেন জ্যোতিষের, কেউ খোঁজ রাখতেন জড়িবুটির, কেউ আবার ছিলেন অ্যালকেমিস্ট। অভিজাতদের অনেকেই এই সব বিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। কেউ আবার অনন্ত যৌবন বা অমরত্ব লাভের আশায় এঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
সমুদ্রাভিযানের যুগ শুরু হলে জাহাজের নাবিকদের কাছে ডাইনিবিদ্যা চর্চাকারীদের কদর বাড়ে। অনিশ্চিত সমুদ্রযাত্রায় বাতাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উইচরা নাবিকদের কাছে ‘উইন্ড নট’ নামে একটি বস্তু বেচত। সেটি আসলে বিশেষ কায়দায় গিঁট লাগানো দড়ি। মনে করা হয়, সেই সময় থেকে উইচদের বিদ্যার বাজারীকরণ শুরু হয়।
আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার উদ্ভবের আগে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের অনেকটাই নির্ভর করতে হত ‘উইচ ডক্টর’ বা ‘হিলার’ হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিদের উপর। তাঁরা জড়িবুটি ও নানা প্রাণিজ ওষুধের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ সারাতে পারতেন। সেই সব চিকিৎসা অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে মিলত।
সপ্তদশ শতকের ফ্রান্সে ডাইনিবিদ্যা চর্চাকারীরা জানাতে শুরু করেন যে, তাঁরা ‘লাভ পোশন’ তৈরি করতে পারেন। কাউকে নিজের প্রেমে পড়াতে বাধ্য করে এই জাদু পানীয়— এমন এক ধারণা বাজারে অবশ্য বহু কাল ধরেই চালু ছিল। কাজ করুক বা না-করুক, লাভ পোশন-এর এক গোপন অথচ বেশ বড়সড় বাজার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়ে যায়। উইচদের হাতেও অর্থ আসতে শুরু করে।
উইচদের অনেকেই ছিলেন গর্ভপাতে পারদর্শী। অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব এড়াতে অনেকেই তাঁদের কাছে আসতেন। কথিত আছে, ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের উপপত্নীদের অনেকেই ক্যাথরিন দেশায়েস নামে এক উইচের কাছ থেকে লাভ পোশন কিনতেন বা গর্ভপাতের জন্য তাঁকে ডেকে পাঠাতেন। এ সবের বাইরে ভবিষ্যদ্বক্তা হিসাবেও ক্যাথরিনের খ্যাতি ছিল। বলা বাহুল্য, ক্যাথরিন শুধু মাত্র ধনীই ছিলেন না, তিনি ফরাসি সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালীও ছিলেন।(সঙ্গের ছবিটি ক্যাথরিনের)
অষ্টাদশ শতক থেকে নিঃসঙ্গ এবং সাধারণত দরিদ্র মহিলাদেরই ‘ডাইনি’ বলে ধরপাকড় করা হত। ক্যাথরিনের মতো প্রভাবশালীদের স্পর্শও করতে পারত না গির্জা বা অন্যান্য শক্তির প্রতিনিধিরা। অষ্টাদশ শতকে ‘যুক্তির যুগ’ শুরু হলেও ইউরোপের বড় বড় শহরগুলিতে গোপনে চলতে থাকে উইচদের ব্যবসা।
উইচদের একটি বড় অংশ এই সময়ে ‘শয়তান উপাসনা’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদদের অনেকেই এই শয়তান উপাসনাকে ক্যাথলিক চার্চ-বিরোধী এক আন্দোলন হিসাবে দেখেছেন। শয়তান উপাসনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ছিল বিভিন্ন যৌন ক্রিয়াকলাপ। আঠারো ও উনিশ শতকের ইউরোপের ধনী ব্যক্তিরা অনেকেই শয়তান উপাসনায় অংশ নিতে শুরু করেন শুধু মাত্র লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই। আর এই সুযোগে তথাকথিত শয়তান উপাসকরাও দু'হাতে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন।
এমন কথাও অনেকে বলেন যে, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিমলার কার্ল ভক্ত ছিলেন মারিয়া উইলিগাট নামের এক গুপ্তবিদ্যা চর্চাকারীর। এ কথাও জানা যায় যে, নাৎসিরা অনেকেই বিপুল টাকা ঢেলেছিলেন ডাইনিবিদ্যা চর্চাকারীদের কাণ্ডকারখানায়। (সঙ্গের ছবিটি হিমলারের)
বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় উইক্কা দর্শনের পুনরুত্থানবাদী আন্দোলন। ইংরেজ নৃতত্ত্ববিদ জেরাল্ড গার্ডনারের নেতৃত্বে এই আন্দোলন বিদ্যাচর্চা হিসাবে শুরু হলেও বেশ কিছু সুযোগসন্ধানী বিষয়টিকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে শুরু করেন বিপুল লাভজনক ব্যবসা। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে গজিয়ে উঠতে শুরু করে ‘উইচ ক্লাব’। এই ক্লাবগুলির অধিকাংশই ছিল নাইট ক্লাব। আজগুবি সব ‘উপাসনা পদ্ধতি’-র অন্তরালে চলত যৌনাচার। (সঙ্গের ছবিটি জেরাল্ড গার্ডনারের)
একুশ শতকে বিষয়টি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে। একদল পণ্ডিত যেমন উইক্কা দর্শন নিয়ে প্রকাশ্যে মত ব্যক্ত করতে থাকেন, তেমনই অগুন্তি ওয়েবসাইট ‘শয়তান উপাসনা’র পদ্ধতি ও সেই সংক্রান্ত নানা সরঞ্জাম বিক্রি করতে শুরু করে। আমেরিকার সমাজ বিষয়ক সমীক্ষা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদনে জানায় যে, সে দেশের প্রায় দশ লক্ষ মানুষ নিজেদের প্রকাশ্যেই উইক্কা দর্শনে বিশ্বাসী বলে দাবি করছেন। আর কত জন যে গোপনে এই সবে বিশ্বাস রাখেন, কোনও দিনই জানা যাবে না।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে ‘প্রয়োজনীয়’ বলে বিবেচিত হতে শুরু করে বিচিত্র সব স্ফটিক, ধূপ এবং জপের মালার মতো সামগ্রী। যেগুলি আবার অনলাইন বিপণীগুলিতেও লভ্য হতে শুরু করে। একটু খোঁজখবর করলেই দেখা যায়, ডাইনিবিদ্যায় ব্যবহৃত স্ফটিক গোলকের দাম এই মুহূর্তে ভারতীয় মুদ্রায় হাজার পাঁচেক টাকা থেকে শুরু। এবং এর শেষ ঠিক কোথায়, তা বলা মুশকিল।
সাম্প্রতিক সময়ের ডাইনিবিদ্যা চর্চাকারীরা কোনও কবরখানায় বা কোনও গুপ্ত কক্ষে তাঁদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। সেই সব অনুষ্ঠানের অনেকগুলিতেই টিকিট কেটে অংশ নেওয়ার বা দর্শক হিসাবে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা থাকে। যে হেতু এই আচারগুলির বেশির ভাগের মধ্যেই নগ্নতা অনিবার্য, সে হেতু টিকিটের দামও হয় আকাশছোঁয়া।
উইচ পেন্টিং, উইচ-সঙ্গীতের আসরের টিকিট ইত্যাদিও বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়। আমেরিকায় অকাল্ট ব্যবসার ক্ষেত্রটি অসংগঠিত এবং মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে বছরে প্রায় ২২০ কোটি ডলারের (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় আঠেরো হাজার কোটি টাকা) ব্যবসা এই ক্ষেত্রে চলে বলে জানা যাচ্ছে। (সঙ্গের ছবিটি ১৭৯৭-৯৮ সালে স্পেনীয় চিত্রকর ফ্রান্সিস্কো গোইয়ার আঁকা ‘উইচেস’ ফ্লাইট’)
বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ডাইনিবিদ্যা চর্চাকারীরা বিপুল ভাবে সক্রিয়। লক্ষ লক্ষ পোস্ট প্রায় প্রতি দিন ছড়িয়ে পড়ে টিকটক বা ইনস্টাগ্রামের মতো সমাজমাধ্যম মারফত। আন্তর্জাতিক ই-কার্টগুলিতে ‘উইচ’ ট্যাগ সম্বলিত পণ্যের বিক্রি দারুণ। এর মধ্যে আবার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ‘পেন্টাগ্রাম নেকলেস’-এর মতো অলঙ্কার।
প্ল্যানচেট করে আত্মা নামানো, বিভিন্ন অপশক্তিকে আহ্বান করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রন্থ বা ‘গ্রিমোয়া’ এবং সেই সংক্রান্ত সাজসরঞ্জামের বিক্রিবাটাও কিছু কম নয় অন্তর্জালের দৌলতে। ২০১৮-য় বিখ্যাত প্রসাধনী নির্মাতা সংস্থা সেফোরা ‘উইচ কসমেটিক কিট’ বাজারে ছাড়ে, যা নিয়ে বিপুল বিতর্ক শুরু হয়। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয় ট্যারো কার্ড-এর মতো সামগ্রীও।
আজকে উইচক্র্যাফট বা ডাইনিবিদ্যা এক কর্পোরেট ব্যবসায় পরিণত। ভাবলেও অবাক লাগে যে, এক সময়ে অগণিত মানুষকে পুড়ে মরতে হয়েছিল শুধু মাত্র ডাইনিবিদ্যা চর্চাকারী সন্দেহে। ‘ধর্মদ্রোহ’-এর সন্ধানে ধর্মীয় কোপ নেমে এসেছিল ইটালীয় দার্শনিক জিওর্দানো ব্রুনোর (১৫৪৮-১৬০০) মতো ব্যক্তিত্বের উপরে। গ্নস্টিক দর্শন চর্চাকারী ব্রুনোকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। (সঙ্গের ছবিটি জিওর্দানো ব্রুনোর বিচার বিষয়ে এত্তোরে ফেরারির দেওয়াল ভাস্কর্য)