পদ্মা সেতুর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশ সরকার। পরিবহণ, পর্যটন থেকে ব্যবসা— এই সেতুর জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়েছে বলে দাবি অনেকেরই। অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করতে তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ। মেঘনা নদীর উপর নতুন আর একটি সেতু তৈরির পরিকল্পনা শুরু করেছে হাসিনা সরকার।
আগে থেকেই দু’টি সেতু আছে মেঘনা নদীর উপর। এ বার সেই নদীর উপর নতুন করে আরও একটি সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে ঢাকার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর যোগাযোগ আরও সহজ হবে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে, যা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট সড়কের বিকল্প অ্যালাইনমেন্ট হিসাবে কাজ করবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার মাধ্যমে পিপিপি-জিটুজি ভিত্তিতে নির্মাণ করা হবে সেতুটি। বাস্তবায়ন করবেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে যুক্ত করে দুই পাশে সড়ক নির্মাণ করবে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)।
সরকারি সূত্রের খবর, ভুলতা-আড়াই হাজার-বাঞ্ছারামপুর সড়কের ফেরিঘাটের ১০০ মিটার স্রোতের বিপরীতে তৈরি করা হবে মেঘনার উপরের এই তৃতীয় সেতুটি।
জানা গিয়েছে, এই সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ৩.১৩ কিলোমিটার। যান চলাচল সহজ করতে সেতুর উভয় দিকে ৪.৪ কিলোমিটার সড়কপথ নির্মাণ করা হবে।
মেঘনা নদীর উপর প্রচুর নৌকা চলাচল হয়। নৌযান চলাচলে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে দিকেও বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে বলে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জানা গিয়েছে, ২০২০ সাল থেকেই এই সেতু নির্মাণ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। এই সেতু তৈরি আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ২০২০-এর মার্চ থেকে। পরে অগস্ট মাস নাগাদ মন্ত্রিসভায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমোদন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘আমাদের সময়’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোরিয়ার নির্মাণ সংস্থা ‘দাইয়ু ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’, ‘হুন্ডাই ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং ‘কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন’ এই সেতু নির্মাণে হাত লাগাবে।
আগামী বছরের মে মাসে সেতুটি নির্মাণে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা রয়েছে।
মেঘনার উপরের নতুন সেতু প্রসঙ্গে সাংসদ ও প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবিএম তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘মেঘনায় তৃতীয় সেতু নির্মাণ হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিকল্প হিসাবে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার হবে। ঢাকা-সিলেটের মধ্যের ২২ কিলোমিটার ও ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যের ২৭ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। এলাকায় কলকারখানার সংখ্যাও বাড়বে।’’
সেতুতে যান চলাচল বাড়াতে আলাদা সড়ক প্রকল্প নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তাজুল।
তাজুল আরও জানান, মেঘনার উপর এই সেতু তৈরি হলে ঢাকার সঙ্গে বাঞ্ছারামপুর-নবীনগর-আখাউড়ার যোগাযোগ সহজ হবে। ঢাকা থেকে আড়াইহাজার-বাঞ্ছারামপুর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভারতের আগরতলার যোগাযোগ ব্যবস্থাও আগের থেকে অনেকটা উন্নত হবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহণও সহজে হবে বলে উল্লেখ করেন তাজুল।
জানা গিয়েছে, সেতুর এক প্রান্তে যানবাহন চলাচল বাড়াতে ৩৬ কিলোমিটারের একটি দুই লেনের সড়ক তৈরি করবে সওজ। বাঞ্ছারামপুরের কড়াইকান্দি ফেরিঘাট থেকে নবীনগর পর্যন্ত এই রাস্তা নির্মাণ করা হবে। এই রাস্তা কুমিল্লার কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়কপথে যুক্ত হবে।
ইতিমধ্যেই এই রাস্তা সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
নতুন সেতুটির অন্য প্রান্ত তৈরি হবে আড়াই হাজারের বিশনন্দী এলাকায়। এর ফলে আগরতলার সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে। আখাউড়া দিয়ে এই সড়কপথ তৈরির কথা রয়েছে। অর্থাৎ, ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে আগরতলা যাওয়ার আরও একটি সহজ পথ তৈরি হচ্ছে।
এ ছাড়া সেতুকে কেন্দ্র করে কড়াইকান্দি এলাকায় স্থলবন্দর নির্মাণের প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন পণ্য ঢাকা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে স্থলবন্দরে যেতে যে সময় লাগে, বাঞ্ছারামপুরে মেঘনা নদীর তীরে স্থলবন্দর হলে চার ঘণ্টা কম সময় লাগবে।
এই সেতু তৈরি হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছে বাংলাদেশের সরকার। পাশাপাশি সারা দেশে অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনে বিপ্লব আসবে বলেও হাসিনা সরকার মনে করছে।
বর্তমানে বিশনন্দী-কড়াইকান্দি ফেরিপথে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগরের সঙ্গে ঢাকা ও অন্যান্য জেলার যোগাযোগ হয়। বর্ষাকালে যাতায়াত যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তা ছাড়াও এই যাত্রাপথে সময়ও অনেক লাগে। আর তা-ও সেতু নির্মাণের অন্যতম কারণ বলে সওজ সূত্রে জানা গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৫ জুন বাংলাদেশের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশের ‘স্বপ্ন-সেতু’ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটারেও বেশি। তবে জলের উপরের অংশে রয়েছে সওয়া ৬ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের এই সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করতে প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
প্রায় দু’দশকের পরিকল্পনার পর তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু। ২০০৭ সালে পদ্মা সেতুর জন্য প্রথম বাজেট পাশ করা হয়।
পদ্মা সেতু তৈরির ফলে সে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের পাশাপাশি কৃষি, কুটিরশিল্প-সহ বহু ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে বলেও হাসিনা দাবি করেছেন।
নতুন মেঘনা সেতু তৈরি হলে বাংলাদেশ সরকারের একই ভাবে লক্ষ্মীলাভ হবে বলেই মনে করছেন সে দেশের অর্থনীতিবিদদের একাংশ।