তথাকথিত নায়কোচিত চেহারা নয়। তবে কৌতুকে ভরা চরিত্রে নিপুণ ভাবে অভিনয় করে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন ফয়জল মালিক। দুই দশক ধরে হিন্দি ফিল্মজগতের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজ়ে প্রহ্লাদের চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। তবে এক সময় সত্যি কথা বলার জন্য অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ হারিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮০ সালে উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদে জন্ম ফয়জলের। তাঁর বাবা পেশায় কেরানি ছিলেন। মা সরকারি স্কুলে পড়াতেন। সেখানেই বাবা-মা, দুই দাদা এবং দুই বোনের সঙ্গে থাকতেন তিনি।
ফয়জলের দাদা কিডনির সমস্যায় মারা যান। বোন পরীক্ষায় ভাল নম্বর না পেয়ে অবসাদে আত্মহত্যা করেন। এক পুরনো সাক্ষাৎকারে ফয়জল জানিয়েছিলেন যে, দাদা এবং বোনের মৃত্যুর পর ভেঙে পড়েন তিনি। ছ’বছর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি তিনি।
ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না ফয়জলের। অভিনয় নিয়ে কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। উচ্চশিক্ষার জন্য বাণিজ্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাবাকে নিজের ইচ্ছার কথা জানান ফয়জল।
ফয়জল যে অভিনেতা হতে চান সে কথা তাঁর বাবাকে জানান। পুত্রের সিদ্ধান্ত মেনে নেন ফয়জলের বাবা। কলেজের পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দেন ফয়জল।
অভিনয় শিখবেন বলে মুম্বই চলে যান ফয়জল। কিন্তু গোড়ার দিকে কাজের সুযোগ পেতেন না তিনি। অডিশন দিলেও চেহারার কারণে নাকি তাঁকে অভিনয়ের সুযোগ দিতে ইতস্তত বোধ করতেন অনেকে।
পরে নিজের চেহারা নিয়েই ‘বিজ্ঞাপন’ দিতে শুরু করেন ফয়জল। ২২ বছর বয়সে মুম্বইয়ে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যাওয়া ফয়জল প্রযোজকদের কাছে গিয়ে বলতে শুরু করেন, ‘‘কালো, মোটা লোকের চরিত্রে অভিনেতার প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন!’’
মুম্বই যাওয়ার পর অভিনয় নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন ফয়জল। দু’তিন মাস প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ছেড়ে দেন তিনি। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, খরচ বাঁচাতেই তিনি প্রশিক্ষণ নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন।
উপার্জনের জন্য একটি চ্যানেলে স্পটবয়ের কাজ করা শুরু করেন ফয়জল। প্রতি মাসে ৭০০ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন তিনি।
কাজের সূত্রে কুমুদ শাহি নামে এক তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয় ফয়জলের। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। ২০১১ সালে কুমুদের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন অভিনেতা।
২০১২ সালে ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ ছবিতে ইনস্পেক্টরের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান ফয়জল। তার পর ‘ফ্রড সাইয়াঁ’, ‘মস্ত মে রহেনে কা’, ‘দেড় বিঘা জমিন’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি।
‘অ্যামেজিং রেস’ নামে একটি রিয়্যালিটি শোয়ে কাজ করার সময় প্রযোজনার সিদ্ধান্ত নেন ফয়জল। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া কঙ্গনা রানাউত অভিনীত ‘রিভলভার রানি’ ছবিতে এগ্জিকিউটিভ প্রযোজকের কাজ করেন ফয়জল। তা ছাড়া ‘মে অউর চার্লস’ এবং ‘সাত উচক্কে’ ছবিতে এগ্জিকিউটিভ প্রযোজকের কাজ করতে দেখা যায় তাঁকে।
‘অভিনেতা’, ‘লেটার্স’ এবং ‘আনইনভাইটেড’-এর মতো একাধিক ছবি প্রযোজনা করেন ফয়জল। ২০১৮ সালে ‘স্মোক’ নামের একটি সিরিজ়েও প্রযোজকের আসনে দেখা যায় তাঁকে।
গানের একটি রিয়্যালিটি শোয়ের প্রযোজনার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফয়জল। তার পর সে চাকরি ছেড়ে একটি টেলিভিশন সংস্থায় প্রযোজনা সংক্রান্ত কাজ শুরু করেন তিনি।
ফয়জল সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানান, অমিতাভ বচ্চনকে সত্যি কথা বলার কারণে তাঁর সঙ্গে কাজের সুযোগ হারান অভিনেতা। ফয়জল বলেন, ‘‘কাজের সূত্রে অনুরাগ কাশ্যপের সঙ্গে আমি অমিতাভ বচ্চনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অমিতাভকে দেখার পর আমি এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম যে কাজের কথা বলার আগে অটোগ্রাফ চেয়ে বসি।’’
অমিতাভের সঙ্গে এক টেবিলে খেতেও বসেছিলেন ফয়জল। সেই প্রসঙ্গে অভিনেতা বলেন, ‘‘অমিতাভের বাড়িতে যখন খেতে বসেছিলাম, তখন একের পর এক খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল। আগের পদ খাওয়াই শেষ হয়নি। অথচ পাতে পরবর্তী পদ হাজির।’’
অমিতাভের বাড়িতে গিয়ে তিলের লাড্ডুও খেয়েছিলেন ফয়জল। তিনি বলেন, ‘‘যখন তিলের লাড্ডু পরিবেশন করা হচ্ছিল, তখন আমি ভেবেছিলাম যে বয়সের কারণে সেগুলি অমিতাভ খেতে পারবেন না। অথচ তিনি পর পর দুটো লাড্ডু খেয়ে ফেললেন। তখনই আমি ভেবেছিলাম, তাঁর বয়স অনেক কম। নিজের বয়স লুকিয়ে রেখেছেন তিনি।’’
ফয়জলের সঙ্গে কাজ সংক্রান্ত আলোচনা হওয়ার সময় অমিতাভ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি কবে থেকে কাজ শুরু করতে চান। অমিতাভের প্রশ্নে ফয়জল জানিয়েছিলেন, ছ’মাস পর কাজ শুরু করবেন তিনি।
ফয়জল সাক্ষাৎকারে জানান, ‘‘কবে থেকে কাজ শুরু হবে তা নিয়ে সত্যি কথা বলে ফেলেছিলাম। পরে জানতে পারলাম, সত্যি বলে বিপদে পড়েছি আমি। অমিতাভের সঙ্গে এই কারণে কাজের সুযোগ হারাই আমি।’’
২০২০ সালে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ফয়জলের বাবা। একই বছরে ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয়ের সুযোগ পান ফয়জল।
‘পঞ্চায়েতে’র উপপ্রধান প্রহ্লাদ পাণ্ডের ভূমিকায় সাবলীল অভিনয়ে নজর কেড়েছেন ফয়জল। সিরিজে প্রধানজির ছায়াসঙ্গী প্রহ্লাদের চরিত্রে দেখা যায় ফয়জলকে। মিষ্টি খেতে ভালবাসে প্রহ্লাদ। কোনও কাজের দায়িত্ব নিতে পিছপা হয় না সে। পর্দায় পিতৃস্নেহ ফুটিয়ে তোলা থেকে শুরু করে হাস্যরস, এমনকি হতাশাও নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ফয়জল। চলতি মাসে ওটিটির পর্দায় মুক্তি পেয়েছে এই সিরিজ়ের তৃতীয় সিজ়ন। এই সিজ়নের ‘স্টার’ যেন তিনিই।