বেছে বেছে ধনী পরিবারের তরুণীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতেন তিনি। তার পর তাঁদের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্কে জড়াতেন। আর এ ভাবে বিত্তবান পরিবারের তরুণীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতাতেন এক যুবক। এই অভিযোগ ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। যে যুবকের বিরুদ্ধে এই প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে, তাঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ‘ঢাকার পোলা’র কীর্তিতে রীতিমতো হতবাক পুলিশ।
ঘটনাটি বাংলাদেশের। গত বুধবার ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে ওই যুবককে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। যুবককে গ্রেফতারের পরই তাঁর প্রতারণার কারবার নিয়ে নানা তথ্য হাতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। যা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ সূত্রে এই খবর জানা গিয়েছে।
ধৃত যুবকের নাম রাজুউল্লা রাজু। তবে তরুণীদের সঙ্গে যখন ভাব জমাতেন ওই যুবক, তখন নানা সময় নিজের বিভিন্ন নাম বলতেন। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, সম্প্রতি ফেসবুকে এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন ওই যুবক। ওই তরুণীকে নিজের নাম ‘মাসুম বিল্লাহ ফারদিন’ বলেছেন রাজু।
তরুণীর আস্থা অর্জনের জন্য নানা কৌশল নিয়েছিলেন রাজু। নিজেকে গাজীপুরের প্রাক্তন সংসদ সদস্যের পুত্র বলে পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ওই তরুণীর সঙ্গে যখন দেখা করেন রাজু, তখন অনেক অসহায় ব্যক্তিদের অর্থ প্রদান করেছিলেন। যা খুব স্বাভাবিক ভাবেই মন কেড়েছিল তরুণীর। তবে সবটাই লোকদেখানো বলে দাবি করেছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, এ ভাবে নানা চাল চেলে ওই তরুণীর আস্থা অর্জন করেন রাজু। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। পুলিশ সূত্রে খবর, এই কায়দায় প্রায় ৫০ জন তরুণীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাঁদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছেন রাজু।
রাজুর গ্রেফতারির খবর পেয়ে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন ওই তরুণী। সেখানে গিয়ে তাজ্জব বনে যান তিনি। তদন্তকারীদের কাছ রাজুর আসল কীর্তি জানার পর হতবাক হয়ে যান ওই তরুণী।
তবে সকল তরুণীর সঙ্গেই যে রাজু প্রেমের সম্পর্ক গড়তেন, তা কিন্তু নয়। কাউকে বোনও পাতাতেন। আসলে রাজুর প্রধান লক্ষ্য ছিল বিত্তশালী তরুণীদের সঙ্গে যেনতেন উপায়ে বন্ধুত্ব পাতিয়ে প্রতারণা করে টাকা হাতানো।
সম্প্রতি ঢাকার কলাবাগান এলাকায় এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রাজুর। কাজের জন্য ওই মহিলার স্বামীকে জাপানে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ জন্য ওই মহিলার কাছ থেকে ১৯ লক্ষ টাকা নেন রাজু। পরে ওই মহিলা বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। এর পরই থানার দ্বারস্থ হন তিনি।
ওই মহিলা ‘প্রথম আলো’কে বলেছেন, ‘‘ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল রাজুর সঙ্গে। ও আমায় বোন পাতিয়েছিল। একটি প্রকল্পের কাজের জন্য আমার স্বামীকে জাপানে পাঠানোর কথা বলে আমাদের কাছ থেকে ১৯ লক্ষ টাকা নিয়েছিল।’’
সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই তদন্তে নামে পুলিশ। এর পরই গত বুধবার গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাজুকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের দাবি, গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতারণা করছেন রাজু। একাধিক পরিচয় ব্যবহার করতেন নিজের।
পুলিশ সূত্রে খবর, সরকারি চাকরি দেওয়া, বদলি, ও বিদেশে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তরুণীদের কাছ থেকে টাকা হাতাতেন রাজু। বিত্তশালী পরিবারের তরুণীদের সঙ্গে ভাব জমাতে নানা পন্থা অবলম্বন করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে খ্যাতনামীদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। পরে ফেসবুকে সেই ছবি পোস্ট করতেন তিনি। যা দেখে তরুণীরা সহজেই রাজুকে বিশ্বাস করতেন।
এই ঘটনার তদন্তে নেমে আরও তথ্য হাতে পেয়েছে পুলিশ। কিশোর বয়স থেকেই প্রতারণায় হাত পাকিয়েছিলেন রাজু। ওই যুবকের বেড়ে ওঠার কাহিনিও নাটকীয়। রাজুর বয়স যখন আড়াই বছর, সেই সময় তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন ঢাকার হাজারিবাগ এলাকার এক নিঃসন্তান দম্পতি।
ওই দম্পতির কাছেই বড় হয়ে ওঠা রাজুর। পড়াশোনাও করেন। কিন্তু কিশোরবেলায় নানা অপরাধের ঘটনায় জড়ান রাজু। তার পর এক দিন ওই দম্পতির ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান রাজু।
রাজুর পালিতা মা ‘প্রথম আলো’কে বলেছেন, ‘‘আমাদের সন্তান হয়নি, বড় আশা করে রাজুকে দত্তক নিয়েছিলাম। নিজেদের সন্তান হিসাবে মানুষ করেছি। কলেজে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু ও বাড়ি থেকে চলে যায়। ও যে প্রতারণার কারবার করত, আমরা জানতাম না।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন বলে দাবি করতেন রাজু। আমেরিকার গ্রিনকার্ড রয়েছে বলেও দাবি করতেন তিনি। প্রতারণার জন্য নিজের নাম বদলে রেখেছিলেন ‘মাসুম বিল্লাহ ফারদিন’। এই নামে ভুয়ো পরিচয়পত্রও বানিয়েছিলেন।
শুধু তা-ই নয়, এই নাম ভাঁড়িয়ে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশও নিয়েছেন রাজু। টিভির পর্দায় ইংরেজিতে গানও গেয়েছেন। নাম-পরিচয় ভাঁড়িয়ে রাজু যে ভাবে দিনের দিন পর দিন প্রতারণার কারবার চালাতেন, তা জানতে পেরে হতবাক হয়ে গিয়েছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রে খবর, রাজুকে জেরা করা হচ্ছে। জেরায় নতুন কোনও তথ্য উঠে আসে কি না, সে দিকেই তাকিয়ে তদন্তকারীরা।