কেবল বিপরীত লিঙ্গের মিলনে সন্তানের জন্ম সম্ভব— সেই ধারণা ভেঙে গিয়েছে আগেই। সমলিঙ্গ সম্পর্কেও সন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব।
সন্তান জন্মের বিষয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা দীর্ঘ দিন ধরেই চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকেরা। বিজ্ঞানই দেখিয়েছে, শুধু নারী নয়, বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুরুষের গর্ভেও সম্ভব সন্তানধারণ।
টেস্টটিউব বেবি থেকে শুরু করে সারোগেসি, জন্মের নানা বিকল্প পদ্ধতি এসেছে। মানুষ তাতে অভ্যস্তও হয়েছে। বেড়েছে পদ্ধতিগুলির জনপ্রিয়তা।
কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানের এমন এক আবিষ্কারের কথা জানা গিয়েছে, যা জন্মের কৌশল একেবারে উল্টেপাল্টে দিতে চলেছে। সন্তানধারণের জন্য যে ন্যূনতম শর্ত প্রয়োজন, তাকেও নস্যাৎ করে দিচ্ছে ওই নতুন পন্থা।
বিজ্ঞানীরা ‘ইন ভার্টো গ্যামেটোজেনেসিস’ নামের এক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। এই পদ্ধতিতে নাকি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য পুরুষের ডিম্বাণু এবং নারীর শুক্রাণু তৈরি করে ফেলা সম্ভব!
পুরুষ এবং নারীর দেহের ভিতরেই বিশেষ পদ্ধতিতে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু তৈরি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘স্টেম সেল সায়েন্স’। যা বদলে দিতে পারে মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ।
কী ভাবে কাজ করে এই বিজ্ঞান? গবেষকদের দাবি, মানবদেহের ত্বকের বিভিন্ন কোষকে প্রশমিত করে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু তৈরি করা যায়। এর ফলে যে কোনও বয়সে সন্তান ধারণ করতে পারবেন যে কেউ।
‘ইন ভার্টো গ্যামেটোজেনেসিস’-এর জন্য প্রয়োজন ‘প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল’। ভ্রুণের প্রাথমিক পর্যায়ে এই কোষ থাকে। স্টেম সেল তৈরিতে তাই ভ্রুণ প্রয়োজন।
প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বা মহিলার দেহের কোষকেও বিশেষ উপায়ে প্রাক্-প্রসব দশার কোষে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। তার পর সেই কোষ দিয়ে শুক্রাণু কিংবা ডিম্বাণু তৈরি সম্ভব।
এই পদ্ধতিতে কোনও মহিলা একাই নিজস্ব শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু দিয়ে সন্তানধারণ করতে পারেন। একই ভাবে পুরুষও নিজের শুক্রাণু এবং নিজ দেহে তৈরি ডিম্বাণু দিয়ে সৃষ্টি করতে পারেন নতুন প্রাণ। এমনটাই দাবি বিজ্ঞানীদের।
তবে উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু আলাদা সারোগেট বা গর্ভধারণকারী প্রয়োজন। শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলনে এই পদ্ধতিতে যে ভ্রুণ তৈরি হবে, তা ধারণ করতে হবে আলাদা কোনও গর্ভে।
তবে এই পদ্ধতি এখনও চালু হয়নি। মানুষের দেহে এখনও তা প্রয়োগ করেও দেখেননি বিজ্ঞানীরা। তবে পশুর দেহে ‘ইন ভার্টো গ্যামেটোজেনেসিস’-এর একাধিক প্রয়োগ সফল হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক ভাবে তারা ইঁদুরের দেহে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে নতুন প্রাণ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। ইঁদুরের লেজ থেকে কোষ নিয়ে তার দ্বারা একই দেহে তৈরি করা হয়েছে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু।
এই পদ্ধতি মানুষের উপর প্রয়োগ করা হলে কী কী বাধা আসতে পারে? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উঠে আসছে খরচের প্রসঙ্গ। যদি মানুষের জন্মের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তবে তা হবে অত্যধিক খরচসাপেক্ষ। সমাজের সব স্তরের মানুষ তা জোগাতে পারবেন না।
যে হেতু এই পদ্ধতিতে বয়স্ক মহিলারাও চাইলে মা হতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে শিশুর ভবিষ্যতের জন্য এবং মায়ের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ‘ইন ভার্টো গ্যামেটোজেনেসিস’ কতটা কার্যকর, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে মহিলা বা পুরুষের ডিম্বাণু বা শুক্রাণু উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যে হরমোনগুলি প্রয়োগ করা হবে, তা সকলের পক্ষে উপযোগী না-ও হতে পারে।
‘ইন ভার্টো গ্যামেটোজেনেসিস’ পদ্ধতিতে শিশুর জন্ম হলে তার একাধিক বাবা এবং মা থাকা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আইনগত ভাবে শিশুটির উপর কার অধিকার, তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
মানুষের ক্ষেত্রে এখনও ‘ইন ভার্টো গ্যামেটোজেনেসিস’ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে ইঁদুরের দেহে এই পরীক্ষার সাফল্যে বিজ্ঞানীদের একাংশ উৎসাহিত।
নানা জটিলতা এবং প্রতিবন্ধকতার সম্ভাবনা থাকলেও পুরুষের দেহে ডিম্বাণু এবং মহিলার দেহে শুক্রাণু উৎপাদন যে সম্ভব, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত নেই।
জটিলতা এবং প্রতিবন্ধকতাগুলিকে অতিক্রম করে যদি ‘ইন ভার্টো গ্যামেটোজেনেসিস’-কে আপন করে নেওয়া যায়, তবে এক ধাক্কায় আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে চিকিৎসা বিজ্ঞান।