ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক চাপানউতর চলছে। এই আবহে চিন সফরে গেলেন মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। সে দেশের সঙ্গে সই করলেন বেশ কিছু চুক্তি। এ সব করে কি ঠিক করলেন তিনি? এতে আখেরে কি চাপ বাড়ল দ্বীপরাষ্ট্রের? ভারতের উপরই বা এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
লক্ষদ্বীপে গিয়ে ছবি পোস্ট করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তা দেখে কুমন্তব্য করেছিলেন মলদ্বীপের তিন মন্ত্রী। সেই নিয়েই শুরু দুই দেশের কূটনৈতিক টানাপড়েন। এ সবের নেপথ্যে চিনের ‘প্ররোচনা’ দেখেছে একটা অংশ। এই আবহে চিন সফরে গেলেন মলদ্বীপের নতুন প্রধানমন্ত্রী মুইজ্জু।
পাঁচ দিন চিনে থাকছেন মুইজ্জু। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী সাজিদা মহম্মদ। ২১টি তোপধ্বনি দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানানো হয়েছে। ১০ জানুয়ারি তিনি চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। চিনের সঙ্গে ২০টি চুক্তিতে সই করছেন তিনি।
একটি চুক্তি হয়েছে পর্যটন নিয়ে। এই বিষয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করার কথা বলেছে দুই দেশ। চুক্তিতে দুই দেশের কৌশলগত সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে। বিপর্যয়ের ঝুঁকি হ্রাস, ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ নিয়ে চুক্তি হয়েছে। মলদ্বীপকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছে চিন। তবে ঠিক কী কী নিয়ে আশ্বাস, তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
রাস্তা, পরিকাঠামো নির্মাণ, মৎস্যশিল্প, মলদ্বীপের রাজধানী মালের উন্নয়নে সাহায্য করবে বলেও জানিয়েছে চিন।
মুইজ্জুর উত্তরসূরিরা সকলেই ক্ষমতায় এসে প্রথম সরকারি সফরের জন্য ভারতকেই বেছেছিলেন। এমনকি ‘চিন-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত মলদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিনও ২০১৩ সালে ক্ষমতায় এসে ভারতেই প্রথম সরকারি সফরে এসেছিলেন।
মলদ্বীপের সরকারি রিপোর্টে দাবি, মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পরেও নাকি তাঁর সরকার দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল গত নভেম্বর মাসে। মুইজ্জুর সম্ভাব্য ভারত সফর সূচি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল মালে। দিল্লির তরফে কি সাড়া মেলেনি! সেই নিয়ে মুখ খোলেনি কোনও পক্ষই।
মুইজ্জু ভোটপ্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরাবেন। তার পর থেকেই একটু একটু করে দূরত্ব বৃদ্ধি করেছে ভারত। তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরিবর্তে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। তাঁকে সরকারি ভাবে সেনা সরানোর অনুরোধ করেছিল মুইজ্জু সরকার।
তার পর থেকেই চাপানউতর শুরু। এ বার চিনের সঙ্গে ২০টি চুক্তিতে সই করল মলদ্বীপ। তার মধ্যে অন্যতম পর্যটন এবং পরিকাঠামো উন্নয়ন। ইতিহাস বলছে, বহু ছোট দেশেই পরিকাঠামো উন্নয়নে (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই) সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চিন। সেই নিয়ে চুক্তি করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন, কথা কি রেখেছে চিন? রিপোর্ট বলছে, চড়া সুদের হারে ঋণের বিনিময়ে এশিয়ার বেশ কিছু ছোট দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে চিন। পরিকাঠামো উন্নয়নে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের কাজ এগিয়েছে খুবই ধীর গতিতে।
নেপালের বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে চিনের সঙ্গে তাদের বিআরআই চুক্তি হয়েছিল। ছ’বছরে পাহাড়ি দেশে একটাও প্রকল্প করেনি চিন। ২০২২ সালে নেপাল সরকারের একটি গোপন রিপোর্ট প্রকাশ্যে এসেছিল। তাতে অভিযোগ করা হয়েছিল, নেপালে পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে স্রেফ জমি দখল করেছে চিন।
রিপোর্ট বলছে, চিনের কাছে মলদ্বীপের প্রায় ১৩০ কোটি ডলার ঋণ রয়েছে। ভারতীয় মুদ্রায় যা ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, এই ঋণের ফাঁদেই মলদ্বীপ ফেলতে চাইছে চিন। শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে চাইছে দ্বীপরাষ্ট্রে। ভারত মহাসাগরে চার দিক থেকে ভারতকে ঘিরে ধরতে চাইছে।
২০৬৬ সাল পর্যন্ত মলদ্বীপের ফেইধু ফিনোলহু দ্বীপ ইজারা নিয়েছে চিন। এই দ্বীপ থেকে ভারতের দূরত্ব মাত্র ৭০০ কিলোমিটার।
চিনের সঙ্গে জোট বাঁধলেও আরও একটি কারণে মলদ্বীপ বার বার শিরোনামে এসেছে। ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠীতে সব থেকে বেশি যোগ দিয়েছিলেন মলদ্বীপ থেকেই। সিরিয়ায় ধরাও পড়েছিলেন অনেকে।
অতীতে মলদ্বীপের মাটি ছিল সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর। সেখানে যুবকদের মগজধোলাই করে জঙ্গি তৈরির অভিযোগ রয়েছে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরেও সক্রিয় হয়েছে মলদ্বীপ থেকে আসা জঙ্গিরা।
চিন অবশ্য এ সব নিয়ে মুখ খোলেনি। উল্টে অনেক সময়ই দেখেও না দেখার ভান করেছে। আর তা করেই কাছে টেনেছে মলদ্বীপকে। বিশাল অঙ্কের টাকা ঋণ দিয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, এই ঋণের কারণে আখেরে বিপাকে পড়তে চলেছে মলদ্বীপই। নেপালের মতোই অবস্থা হতে পারে তাদের। পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে বৃদ্ধি পেতে পারে ঋণের বোঝা, যা থেকে বেরিয়ে আসা হয়ে উঠতে পারে কঠিন। ছবি: সংগৃহীত।