কেন্দ্রীয় বাজেট ঘোষণার দিন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বড় ঘোষণা করেছিলেন বিহারের মখানা চাষ নিয়ে। মখানা চাষে বিহারের চাষিদের উৎসাহ দিতে একটি পৃথক বোর্ড গঠনের কথা ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী।
ভারত ও বিদেশের বাজারে দ্রুত বাড়ছে পুষ্টিকর এই সুপারফুডটির চাহিদা। তেলেভাজা ও মিষ্টি খাবারের বিকল্প হিসাবে স্বাস্থ্যসচেতনদের খাবারের তালিকায় অপরিহার্য হয়ে উঠছে এই খাবারটি। সাধারণ মানুষের চাহিদা বুঝে কেন্দ্রও মখানা উৎপাদনে বিশেষ উৎসাহ জোগাচ্ছে পড়শি রাজ্যকে।
পদ্মফুলের বীজ, ফক্স নাট বা মখানা একই বীজের অনেক নাম। ওজন থেকে রক্তে গ্লুকোজ়ের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে মখানার জুড়ি মেলা ভার। প্রোটিন, ফাইবার এবং প্রয়োজনীয় খনিজে সমৃদ্ধ একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার এই মখানা। এই সুপারফুডের বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মাথায় রেখেই বিহারের মখানা চাষকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পদক্ষেপ করেছে সরকার।
বিশ্বের বৃহত্তম মখানা উৎপাদনকারী রাজ্য হল বিহার। পুষ্টিগুণ এবং বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাহিদার পাশাপাশি সাম্প্রতিক ‘সুপারফুড’ তকমা এই খাদ্যটিকে পঞ্জাবের বাসমতী চাল বা কাশ্মীরের কেশরের মতো পরিচিতি এনে দিয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে যে মখানা সরবরাহ হয়, তার ৮০ শতাংশই ভারতে উৎপাদিত হয়। তার আবার ৯০ শতাংশ একা বিহারই উৎপাদন করে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বিহারে ৩৫ হাজার হেক্টর জুড়ে ১০ হাজার টন মখানা উৎপন্ন করেন ২৫ হাজার চাষি। দ্বারভাঙা, মধুবনী, পূর্ণিয়া, কাটিহার, অররিয়া, কিশানগঞ্জ জেলাগুলি মূলত মখানার চাষে শীর্ষস্থানীয়।
এই জেলাগুলি মিথিলাঞ্চল এলাকার অন্তর্গত। ২০২২ সালে মিথিলার মখানার মুকুটে যুক্ত হয়েছে জি-আই ট্যাগও। এক সময় বিহারের যে সব বন্যাপ্রবণ এলাকাকে কৃষিকাজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে ধরা হত, সেগুলিই এখন মখানা চাষের সম্পদ বলে মনে করা হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা সত্ত্বেও মাখনা চাষ এখনও শ্রমসাধ্য। এই শিল্পের বৃদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায় চাষের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম। দিন রাত এক করে হাঁটু বা বুক জলে নেমে পদ্মের কালো বীজ তুলে এনে তা বেশ কয়েকটি ধাপে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়।
পদ্মের কালো বীজগুলিকে ‘কালো হিরে’র সঙ্গেও তুলনা করা হয়। জলাভূমির মাটিতে পোঁতা মখানা চারাগাছের কন্দ থেকে অনেকগুলি শাখা বার হয়। এক একটি গাছে প্রায় ১৪-২০টি ফুল হয়। ফুল থেকে গোলাকৃতি কাঁটাযুক্ত ফল হয়।
এই ফলের মধ্যে ২০-২৫টি ছোট ছোট চেরি ফলের মতো গোলাকৃতি কালো-বাদামি রঙের শক্ত বীজত্বকযুক্ত বীজ থাকে। এই বীজ ভাল ভাবে শুকিয়ে নিয়ে গরম কড়াইয়ে বালিতে ভেজে নিতে হয়। এর পর মেঝেয় ফেলে কাঠের পাটাতন দিয়ে আঘাত করলেই বীজের ত্বক ফেটে সাদা ধবধবে খই পাওয়া যায়।
প্রকৃতপক্ষে, মাত্র ৪০ শতাংশ বীজ থেকে ভোজ্য মখানা পাওয়া যায়। এর মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ রফতানির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে। প্রবল ব্যবসায়িক লাভ থাকা সত্ত্বেও সে ভাবে কেন বাণিজ্যিক লাভের মুখ দেখতে পান না চাষিরা? তার প্রধান কারণ হল সঠিক ‘ব্র্যান্ডিং’ ও বিপণন কৌশলের অভাব।
পাইকারি বাজারে মখানার দাম ৩৫০-৮০০ টাকা প্রতি কেজি হলেও খুচরো বাজারে এর দাম ১০০০-১৬০০ টাকা। স্বাদযুক্ত প্যাকেটজাত মখানার ক্ষেত্রে ২০ গ্রামের প্যাকেটের দাম ৬০ টাকা থেকে শুরু। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম শুনলে চোখ কপাল উঠতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি মখানার দাম ১৩ হাজার টাকা।
একটি বাণিজ্য প্ল্যাটফর্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিকিল কামাথ সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডলে মখানার বিপণন ও এই শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে মতামত জানান। তিনি দাবি করেন, মখানা ৬ হাজার কোটি টাকার শিল্পে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
উচ্চমূল্যের অর্থকরী ফসল হিসাবে স্বীকৃত মখানা চাষ বেশ কষ্টকর। এটিতে মূলধন প্রচুর লাগে এবং শ্রমসাধ্যও বটে। কৃষকেরা এখনও হাতে ফসল সংগ্রহ এবং রোদে শুকোনোর পদ্ধতির উপর নির্ভর করেন। এর ফলে ফসলের মান নেমে যায় এবং ফলনও কম হয়। প্রতিকূলতা থাকলেও ২০১৩ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মখানার উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বীজের খই উৎপাদন ৯,৩৬০ টন থেকে বেড়ে ২৩,৬৫৬ টন হয়েছে। বীজ উৎপাদন ২০,৮০০ টন থেকে বেড়ে ৫৬,৩৮৯ টন হয়েছে। চাষের এলাকা ১৩,০০০ হেক্টর থেকে ৩৫,২২৪ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে।
এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিহার কি এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে? না কি আরও একটি ‘সোনার খনি’ ভারতের হাতছাড়া হয়ে যাবে? চিন, কোরিয়া, তাইল্যান্ড, ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক বাজারগুলিতে চাহিদা প্রসারিত হলেও সঠিক বাণিজ্যিক পরিকাঠামোর অভাব এর বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন চাষের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা।
বাসমতী চাল বা দার্জিলিং চায়ের মতো বিশ্বব্যাপী প্রচারের ক্ষেত্রে মখানা বেশ কিছুটা পিছিয়েও রয়েছে। বিহারে মখানার উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হলেও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণনকেন্দ্র এই রাজ্যে নেই। গুজরাত ও অসম— এই দু’টি রাজ্যই মখানা রফতানিতে একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে রেখেছে।
মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ ও পরিকাঠামোর অভাবের কারণে চাষিরাও খুব কম মুনাফা অর্জন করেন।
বেশ কয়েকটি স্টার্ট আপ সংস্থা বর্তমানে ৩ হাজার কোটি টাকা মূল্যের এই শিল্পের সম্প্রসারণে এগিয়ে এসেছে। মনে করা হচ্ছে, আগামী দিনে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটিতে পৌঁছবে এই বাজার।