কপালে সিঁদুর, গলায় মালা, বিশালাকার মূর্তির উপর ভক্তরা দুধ ঢালছে। মূর্তি ঘিরে জনতার ভিড়। পুজোই হচ্ছে বটে, তবে এই দৃশ্য কোনও মন্দিরের নয়। কোনও দেব-দেবীর মূর্তিরও আরাধনা করা হচ্ছে না। বরং অভিনেতা রজনীকান্তের বিশাল পোস্টার ঘিরে ভক্তদের এই উন্মাদনা!
শুধু রজনীকান্ত নন, বিজয়, কমল হাসন, সুরিয়া, বিজয় সেতুপতি— সব অভিনেতাকেই দক্ষিণী ছবির ভক্তরা দর্শকরা দেবতাজ্ঞানে পুজো করেন। এই প্রথার চল দক্ষিণের প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। বিশেষ করে, প্রিয় অভিনেতার সিনেমা মুক্তির দিন প্রেক্ষাগৃহের সামনে অথবা তাঁদের জন্মদিন এ ভাবেই উদ্যাপন করা হয়। তাঁরা আসলে ভক্তের ভগবান!
দক্ষিণী তারকাদের নিয়ে ভক্তদের মাতামাতি বহু বছর আগেই শুরু হয়েছিল। এমজি রামচন্দ্রণ, শিবাজী গণেশন প্রমুখ অভিনেতাও বাদ যাননি এই উদ্যাপন থেকে। তবে এই উৎসবের আড়ালেই থাকে অভিনেতাদের প্রতি ভক্তদের অসীম ভালবাসা।
কখনও কখনও ভক্তদের ভিড়ের মধ্যে থেকেই উঠে আসে প্রতিভার ঝাঁক। কেউ আবার তাঁর প্রিয় অভিনেতাদের মতোই দেখতে হন। ধীরে ধীরে তাঁদেরই হাবভাব অনুসরণ করতে শুরু করেন তাঁরা। পরে ছোট মঞ্চের অভিনেতা হয়েই সারাজীবন কাটে।
প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সোমসুন্দরম, কথিরের মতো অভিনেতাকে অতিমারির সময় সব্জি বিক্রি করতে হয়েছে, কেউ সামান্য দেড় হাজার টাকা রোজগারের জন্য বাড়ি থেকে বহু দূরে গিয়ে মঞ্চে ছোট অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সোমসুন্দরম ‘রজনী সোম’ নামে পরিচিত। দেখতেও ছিলেন রজনীকান্তের মতোই। ১২ বছর বয়স থেকে রজনীকান্তকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করত। এমনকি, ‘বাশা’ ছবিতে রজনীকান্তকে অটোচালকের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখে সোমও সিদ্ধান্ত নেন, ভবিষ্যতে অটো চালিয়েই তিনি জীবিকা নির্বাহ করবেন।
তিনি মঞ্চে যখন রজনীকান্তের হাবভাব অনুসরণ করে নাচ বা অভিনয় করতেন, তখন দর্শকরাও খুব সহজেই আসল রজনীকান্তের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতেন তাঁকে। এখন তিনি দু’সন্তানের বাবা। সংসারের দায়িত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করতে হয়।
টেলিভিশনের পর্দায় বড় কোনও চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ না পেলেও একটি তামিল ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব পান। কিন্তু পরে সেই প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়।
রজনীকান্তের ব্যক্তিজীবনও প্রভাব ফেলে ভক্তদের জীবনে। অভিনেতা কমল হাসন ছিলেন রজনীকান্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সোমের প্রিয় বন্ধু কথির। তাঁর সঙ্গে কমল হাসনের চেহারার সাদৃশ্য রয়েছে।
কথিরের বাবা-মা কারখানায় কাজ করতেন। কিন্তু কমল হাসনকে নকল করে ছেলে অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত হোক, চাইতেন না তাঁরা। তবুও সব বাধা অগ্রাহ্য করে ৩০ বছর ধরে মঞ্চে অনুষ্ঠান করে চলেছেন কাথির। বিভিন্ন উৎসবের দিনে তিনি দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গায় অনুষ্ঠান করেন।
করোনাকালে কাজ না পাওয়ায় শাক-সব্জিও বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে। দু’বেলার খাবার জোগাড় করতে গিয়ে কখনও রেশনের দোকানে কাজ করেন, আবার কখনও কাজ থাকে না তাঁর।
এই প্রসঙ্গে বিজয়কান্ত কুমারের ‘বডি-ডাবলের’ একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। অভিনেতা বিজয়কান্তের একটি রাজনৈতিক বৈঠকে আসতে দেরি হওয়ায় ওই বডি-ডাবলকে অনুরোধ করা হয় দর্শকদের মনোযোগ কাড়তে। সেখানে উপস্থিত দর্শকেরা সকলেই তাঁকে অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ বিজয়কান্ত হিসাবে মেনে নিয়েই অভ্যর্থনা জানান। এই মুহূর্তটি তাঁর জীবনে গভীর ছাপ ফেলে।
করোনার আগে অনুষ্ঠান পিছু পাঁচ হাজার টাকা করে পেলেও করোনার পরে তার অর্ধেক পারিশ্রমিকও পান না।
দক্ষিণী ছবির এই ‘বডি-ডাবল’রা একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত আয়ের অভাব তাঁদের দেহের উপরেও প্রভাব ফেলেছে। অর্থের অভাবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা রাজ্য সরকার এবং শিল্পী সমিতিকে অতিমারি চলাকালীন সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছিলেন।