আড়াই বছর ধরে প্রৌঢ়াকে তাঁর ফ্ল্যাটের বাইরে বেরোতে দেখা যায়নি। এমনকি, ফ্ল্যাট থেকে তাঁর সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছিল না। আবাসনের বাসিন্দাদের দাবি, বার বার পুলিশে খবর দিয়েও লাভ হয়নি। অবশেষে প্রৌঢ়ার ফ্ল্যাট থেকে তাঁর পচাগলা দেহ উদ্ধার হয়। যদিও এত দিন ধরে ওই ফ্ল্যাটের ভাড়া কেটে নিচ্ছিলেন আবাসন কর্তৃপক্ষ।
বিবিসি-র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের পেকহ্যাম জেলার একটি আবাসন থেকে ৫৮ বছরের শীলা সেলেওনের দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। গত জুলাই মাসে এই ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেয় তারা।
তদন্তকারীদের দাবি, আবাসনের পরিচালন কর্তৃপক্ষ পিবডি হাউজ়িং অ্যাসোসিয়েশন এবং পুলিশকে বার বার শীলার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানিয়েছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা। অভিযোগ, তবে তারা এ বিষয়টি নিয়ে ততটা তৎপর ছিলেন না।
তদন্তে জানা গিয়েছে, ২০২০ সাল থেকে অন্তত ৩ জন পিবডিকে শীলার নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তবে সে কথায় নাকি বিশেষ কর্ণপাত করেননি তারা।
২০২০ সালে শীলার আবাসনের সমস্ত বাসিন্দাদের গ্যাসের সংযোগ খতিয়ে দেখেছিল পিবডি। শীলার তরফে কোনও জবাব না পেয়ে উল্টে তাঁর গ্যাসের লাইনই কেটে দেয় তারা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শীলার পড়শিদের ফোন পেয়ে অবশেষে তাঁর ফ্ল্যাটে পৌঁছয় মেট্রোপলিটন পুলিশ। তাঁর ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে প্রৌঢ়াকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
লন্ডন ইনার সাউথ করোনার্স কোর্টে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, নীল পায়জামা আর সাদা টপ পরা প্রৌঢ়ার পচাগলা দেহ পড়েছিল তাঁর ফ্ল্যাটের সোফায়। তা এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর দাঁতের রেকর্ড খতিয়ে দেখে সেটি শীলার দেহ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
আবাসনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মেডিক্যাল সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করতেন প্রৌঢ়া। শেষ বার তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালের অগস্টে। সে সময় চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছিলেন শীলা।
কী ভাবে মৃত্যু হল শীলার? তাঁকে কি খুন করা হয়েছিল? প্রৌঢ়ার দেহ এতটাই পচেগলে গিয়েছিল যে ময়নাতদন্তে সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। যদিও ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, বেশ অসুস্থ ছিলেন তিনি। পরিপাকতন্ত্রের কলা (টিস্যু) ফুলে গিয়েছিল। সঙ্গে অন্ত্রের প্রদাহও ছিল।
প্রৌঢ়ার সম্পর্কে খোঁজখবর করতে বলায় ২০২০ সালের অক্টোবরে দু’বার তাঁর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন পুলিশ আধিকারিকেরা। তবে শীলার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। বিষয়টি মেট্রোপলিটন পুলিশ কন্ট্রোলারের কাছে জানিয়েওছিলেন তাঁরা। তবে ভুলবশত ওই আধিকারিক জানিয়ে দেন, শীলা ভাল ভাবেই বেঁচেবর্তে রয়েছেন। এর পর তা পিবডি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
গোটা ঘটনায় ওই মেট্রোপলিটন পুলিশ কন্ট্রোলারের ঘাড়েই দায় চাপিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্তকারী বিভাগের প্রধান ইনস্পেক্টর আমান্ডা মাহুইনি আদালতে জানিয়েছেন, গত বছর ওই আধিকারিক কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে পদক্ষেপ করা হবে।
ফেব্রুয়ারিতে শীলার দেহ উদ্ধার করেছিলেন মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিটেকটিভ সার্জেন্ট স্কট ফিশার। তাঁর এক কামরার ফ্ল্যাটটি অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানোগোছানো ছিল বলে জানিয়েছিলেন তিনি। ফিশার বলেন, ‘‘প্রৌঢ়ার দেহে খয়েরি রঙের এক ধরনের পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল। সম্ভবত, পচনের জেরেই তা দেহে ধরা পড়েছিল।’’
লন্ডনের মতো বড় শহরে এক প্রৌঢ়ার এ হেন পরিণতিতে হতবাক তাঁর আবাসনের পড়শি-সহ পুলিশ আধিকারিকেরা। তদন্তকারী আধিকারিক জুলিয়ান মরিস বলেন, ‘‘যে কোনও মৃত্যু দুঃখজনক। তবে দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে কী ভাবে তা কারও কাছে ধরা পড়ল না, সেটা বুঝে উঠতে অসুবিধা হয়।’’
আবাসনের এক বাসিন্দা অবশ্য সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছেন, ২০১৯ সালের গ্রীষ্মের শেষে শীলার ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ পেয়েছিলেন তিনি। এমনকি, পোকামাকড়ও বেরোতে দেখেছিলেন। অন্য এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘ওই প্রৌঢ়া যে নিখোঁজ, তা কেউ লক্ষই করলেন না! এটা ভেবেও আশ্চর্য লাগছে যে ওই প্রৌঢ়ার কোনও আত্মীয় ছিলেন না।’’
এই ঘটনায় পিবডি-র সিইও অ্যাশলিং ফক্স স্বীকার করেছেন, শীলার খোঁজখবর রাখতে পারেননি তাঁরা। অ্যাশলিং বলেন, ‘‘ঘটনার পর মনে হচ্ছে, হয়তো আমরা এ বিষয়ে অনেক কিছুই করতে পারতাম।’’
শীলার মৃত্যুর ঘটনায় হতবাক তাঁর পড়শিরা। অনেকেই আশ্চর্য, কী ভাবে এত দিন ধরে প্রৌঢ়ার ফ্ল্যাটভাড়া কেটে নিচ্ছিলেন পিবডি কর্তৃপক্ষ? সে ধাঁধারও সমাধান হয়েছে।
২০২০ সালের জুনে শীলার সাড়াশব্দ না পেয়ে যখন গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল পিবডি, তার ৩ মাস আগেই ‘ইউনিভার্সাল ক্রেডিট’-এর মাধ্যমে ফ্ল্যাটভাড়া দেওয়ার বন্দোবস্ত করার জন্য আবেদন করেছিলেন শীলা।
‘ইউনিভার্সাল ক্রেডিট’-এর মতো সরকারি ব্যবস্থায় ব্রিটেনের কর্মহীন বা নিম্ন আয়ের নাগরিকদের সংসার চালাতে মাসে এক বা দু’বার অর্থসাহায্য করা হয়। তা থেকেই প্রতি মাসে শীলার অ্যাকাউন্ট থেকে ফ্ল্যাটের ভাড়া কাটছিলেন আবাসন কর্তৃপক্ষ।