এ এক ‘অমূল্য রতন’-ই বটে। দেশের মাটিতে এই প্রথম লিথিয়ামের খোঁজ পাওয়া গেল। যার জন্য এ যাবৎ কাল অন্য দেশের উপর হাঁ করে বসে থাকতে হত, এ বার সেই সম্পদ মিলল ভারতেই। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দুনিয়ায় এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ রিচার্জেবল ব্যাটারি। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে যে ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম। ভারতে লিথিয়াম খনির ভান্ডার খুঁজে পাওয়ায় এর দৌলতেই বদলে যেতে পারে দেশের ভবিষ্যৎ। আম-আদমির জীবনেও মিলতে পারে সুফল। সুলভ হতে পারে রিচার্জেবল ব্যাটারি।
জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলার সালাল-হাইমানা এলাকায় লিথিয়ামের ভান্ডারের হদিস পেয়েছে ভারতীয় ভূ-তাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ (জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)।
জম্মু ও কাশ্মীরের অন্যতম প্রাচীন শহর রিয়াসি। যা জম্মু ডিভিশনের অন্তর্গত। ছবির মত সুন্দর এই জনপদ জম্মু থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে। এই জেলাতেই রয়েছে বৈষ্ণো দেবী, শিব খোরির মতো তীর্থস্থান। এ বার সেই তালিকায় জুড়ল দেশের প্রথম লিথিয়ামের ভান্ডারের নাম।
প্রথম বার লিথিয়ামের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে দেশে। তা-ও আবার কম পরিমাণ নয়। কেন্দ্রীয় খনি মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, ৫.৯ মিলিয়ন টন অর্থাৎ, ৫৯ লক্ষ টন লিথিয়াম পাওয়া গিয়েছে।
এক সঙ্গে বিপুল পরিমাণ লিথিয়ামের সন্ধান নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে বলেই মনে করছে বণিক মহল। এর ফলে দেশে ব্যাটারি শিল্পে নবজোয়ার আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশে লিথিয়াম কেন ‘অমূল্য রতন’? স্মার্টফোন, ল্যাপটপে যে ধরনের রিচার্জেবল ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, তাতে অন্যতম প্রধান উপাদান হল লিথিয়াম। শুধু তাই নয়, বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রেও লিথিয়ামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। দূষণ রুখতে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে জোর দিচ্ছে কেন্দ্র। আর এমন গাড়ির জন্য যে ব্যাটারির প্রয়োজন হয়, তা হল লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি।
এটা প্রযুক্তির যুগ। যত দিন গড়াচ্ছে, ততই প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং মোবাইল ফোনের মতো বৈদ্যুতিন যন্ত্রের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে যেহেতু এত দিন লিথিয়াম পাওয়া যেত না, তাই এর জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভর করতে হত। অর্থাৎ, আমদানি করতে হত লিথিয়াম। যা খরচ সাপেক্ষ। এ বার দেশেই যেহেতু বিপুল পরিমাণে লিথিয়ামের হদিস মিলল, তাতে ব্যাটারি তৈরির ব্যয় যেমন কমবে, তেমনই ‘আত্মনির্ভর’ হবে দেশ। অন্তত এমনটাই মনে করছে সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে যে পরিমাণে লিথিয়াম পাওয়া গেল, তাতে আগামী দিনে দেশে ব্যক্তিগত বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন আরও বাড়বে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির সংখ্যা ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। বর্তমানে দূষণ মোকাবিলায় বৈদ্যুতিক গাড়ির দিকে ঝুঁকেছেন নাগরিকদের বড় অংশ। এই পরিস্থিতিতে দেশে লিথিয়ামের সন্ধানে এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল।
বৈদ্যুতিক গাড়িতে যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, তাতে কয়েক গ্রাম লিথিয়াম থাকে। একটি সাধারণ বৈদ্যুতিক গাড়িতে যে ধরনের ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়, তাতে ৫ হাজার ব্যাটারির সেল থাকে। একটি বৈদ্যুতিক গাড়িতে ১০ কেজি লিথিয়ামের প্রয়োজন হয়। ৯০টি বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা মেটাতে পারে ১ টন লিথিয়াম। সে ক্ষেত্রে ভারতে ৫৯ লক্ষ টন লিথিয়াম পাওয়া গিয়েছে। এই কারণেই মনে করা হচ্ছে, দেশের জন্য এ এক অমূল্য সম্পদ।
অস্ট্রেলিয়া, চিলি, আর্জেন্টিনায় কঠিন শিলা এবং ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে লিথিয়াম পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা থেকে লিথিয়াম আনার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ করেছিল ভারত সরকার।
আমদানি করার ফলে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের দাম বেশি হত। দেশে লিথিয়ামের ভান্ডার পাওয়া যাওয়ায় আগামী দিনে সস্তায় বৈদ্যুতিক যন্ত্র হাতে পেতে পারেন সাধারণ মানুষ।
লিথিয়ামের ভান্ডার পাওয়ার পর এ বার তা খনন এবং পরিশোধনের জন্য নিলাম ডাকা হবে। সরকারি সূত্রে খবর, শীঘ্রই সেই কাজ শুরু করা হবে।
দেশে লিথিয়ামের ভান্ডার পাওয়া গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা খনন করার কাজ খুব একটা সহজ নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, লিথিয়াম খননের কাজ পরিবেশবান্ধব নয়।
লিথিয়াম খনন করার পর তা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে দগ্ধ করা হয়। নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাতাসে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়।
দেশকে ‘আত্মনির্ভর’ হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যে পরিমাণে লিথিয়াম পাওয়া গেল দেশে, তাতে মোদীর এই লক্ষ্যপূরণ অনেক কদম এগোল বলেই মনে করছে সরকার। কেন্দ্রীয় খনি সচিব বিবেক ভরদ্বাজ বলেছেন, ‘‘আত্মনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ খুঁজে পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’’
শুধু তাই নয়, লিথিয়াম নিয়ে চিনের সঙ্গেও এ বার পাল্লা দিতে পারে ভারত। চলতি বছরে বলিভিয়ায় লিথিয়ামের ভান্ডারের উন্নয়নের জন্য চুক্তি সাক্ষর করেছে চিন। যেখানে ২১ মিলিয়ন টন লিথিয়াম রয়েছে। যেখানে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লিথিয়াম রয়েছে। এই আবহে দেশের মাটিতেই লিথিয়ামের ভান্ডার পাওয়া যাওয়ার ফলে প্রতিপক্ষ দেশকেও ভারত চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে বলে আশা।