দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার করেছে ইডি। আবগারি দুর্নীতি মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ৯ বার তলব করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। কিন্তু তিনি হাজিরা দেননি। এর পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ তাঁর বাড়িতে পৌঁছয় ইডি।
ঘণ্টা দুয়েকের তল্লাশি অভিযান শেষে বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁর মোবাইল ফোন। এর পরেই রাত ৯টা নাগাদ কেজরীওয়ালকে গ্রেফতার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। শুক্রবার পিএমএলএ আদালতে হাজির করানো হবে আপ প্রধানকে।
তবে এই প্রথম নয়, চেয়ারে থাকাকালীনই গ্রেফতারির সঙ্কেত পেয়েছেন আরও তিন মুখ্যমন্ত্রী! সেই তালিকাতেই নাম সংযোজন হল কেজরীর। সেই তিন জন হলেন বিহারের লালু প্রসাদ যাদব, তামিলনাড়ুর জয়ললিতা এবং ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন। তবে এঁরা তিন জনেই গ্রেফতার হয়েছেন ইস্তফা দেওয়ার পর। এর বাইরে পদ থেকে সরার কিছু সময় পরেও গ্রেফতার হয়েছেন একাধিক রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরা।
গত ৩১ জানুয়ারি জমি জালিয়াতি সংক্রান্ত বেআইনি আর্থিক লেনদেন মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির হাতে গ্রেফতার হন হেমন্ত সোরেন।
৬০০ কোটি টাকার ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ রয়েছে হেমন্তের বিরুদ্ধে। সেই তদন্তের সূত্রে ৩১ জানুয়ারি দুপুরে হেমন্তের রাঁচীর বাড়িতে তল্লাশি চালায় ইডি। প্রায় সাত ঘণ্টা তল্লাশির পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তার আগে রাজভবনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন হেমন্ত।
হেমন্ত মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর নিমেষে বদলে যায় ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক পটভূমি। জেএমএম নেতা চম্পই সোরেনকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানান রাজ্যপাল সিপি রাধাকৃষ্ণণ। সেই মতো রাঁচীর রাজভবনের দরবার হলে ঝাড়খণ্ডের সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন চম্পই।
তবে হেমন্ত একা নন, তাঁর আগেও ঝাড়খণ্ডেরই দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছিলেন।
২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর দিল্লির এক নিম্ন আদালত হেমন্তের বাবা তথা ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেনকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব, শশিনাথ ঝাকে অপহরণ করে খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়।
শিবু তখন তৎকালীন মনমোহন সিংহ সরকারের কয়লামন্ত্রী ছিলেন। শশিনাথ ১৯৯৪ সালের মে মাসে নিখোঁজ হন। পরে রাঁচীতে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। ২০০৭ সালের আগস্টে, দিল্লি হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে শিবুকে বেকসুর খালাস করে। তিন বার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হন শিবু। কিন্তু এক বারও মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ১০ দিনের মাথায় ইস্তফা দিতে হয়। বাকি দু’বার যথাক্রমে ১৪৫ দিন এবং ১৫৩ দিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি।
২০০৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঝাড়খণ্ডের চতুর্থ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন নির্দল বিধায়ক মধু কোড়া। তিনিও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। তাঁর আমলে দুর্নীতির অভিযোগে পরে গ্রেফতার হন মধু। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ এবং হিসাব-বহির্ভূত সম্পত্তি রাখার অভিযোগ উঠেছিল।
খনি কেলেঙ্কারিতেও নাম জড়িয়েছিল মধুর। ঘুষ নিয়ে কয়েকটি সংস্থাকে নিয়ম ভেঙে কয়লা ব্লকের বরাত পাইয়ে দেওয়া এবং সেই অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে। ২০১৭ সালে ওই মামলায় দোষী প্রমাণিত হয়ে তাঁর সাজাও হয়েছিল।
অবশ্য তাঁর দেড় বছর আগেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন কোড়া। হেমন্তের মতো গ্রেফতারির কারণে ইস্তফা দিতে হয়নি তাঁকে।
গ্রেফতারির কারণে মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফার নজির অবশ্য হেমন্তের আগে মাত্র দু’জন মুখ্যমন্ত্রীর। বিহারের লালুপ্রসাদ এবং তামিলনাড়ুর জয়ললিতা। ১৯৮৫ সালে বিহারের ট্রেজারি এবং বিভিন্ন দফতরে অনিয়ম চিহ্নিত করেন তৎকালীন সিএজি টিএন চতুর্বেদী। তার এক দশক পরে সেই সূত্রেই সামনে এসেছিল পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে পশুপালন দফতরের লেনদেন খতিয়ে দেখতে জেলাশাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অবিভক্ত বিহারের অর্থসচিব। এর দু’মাস পরে পটনা হাই কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়।
১৯৯৭ সালের ২৩ জুন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ-সহ ৫৫ জনের নামে সিবিআই চার্জশিট পেশ করেছিল। এর এক মাস পরে ২৫ জুলাই লালুকে গ্রেফতার করতে আধা সেনা দিয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলেন সিবিআইয়ের তৎকালীন যুগ্ম অধিকর্তা উপেন বিশ্বাস।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গ্রেফতারি এড়ালেও মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন লালু। গদিতে বসিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রাবড়ী দেবীকে। ৩০ জুলাই সিবিআই আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যান লালু। ১৩৫ দিন পরে জামিন পেলেও আর কোনও দিন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি তিনি। পরে পশুখাদ্য দুর্নীতি সংক্রান্ত একাধিক মামলায় সাজা হয় তাঁর।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলায় বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ইস্তফা দিয়েছিলেন এডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা। জেলেও গিয়েছিলেন।
অবশ্য কর্নাটক হাই কোর্টের রায়ে ‘বেকসুর খালাস’ হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে ২০১৫-য় আবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ‘আম্মা’।
দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় রয়েছেন আরও এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী— হরিয়ানার ওমপ্রকাশ চৌটালা। চার দফায় হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রিত্ব সামলানো ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দলের (আইএনএলডি) নেতা চৌটালা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলায় এক দশকেরও বেশি সময় কারাবাস করেছেন।
২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নায়ডু। স্কিল ডেভেলপমেন্ট দুর্নীতি মামলায় তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-র প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২০২১ সালে এই দুর্নীতির মামলায় চন্দ্রবাবুর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। তিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তী জামিনে বাইরে রয়েছেন।
এ ছাড়া দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় রয়েছেন, বিজেপির বিএস ইয়েদুরাপ্পা (কর্নাটক), ডিএমকের এম করুণানিধি (তামিলনাড়ু)। এর পর বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার হন কেজরীওয়াল। তবে তিনি এখনও ইস্তফা দেননি। আপের বক্তব্য, প্রয়োজনে জেলে বসেই সরকার চালাবেন কেজরী। কিন্তু কোনও মতেই মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেবেন না। দিল্লির মন্ত্রী তথা আপ নেত্রী অতিশী মারলেনা জানিয়েছেন, কেজরীওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন। তিনি জেলে বসে সরকার চালাবেন।