বিপুল ভিড়। পটনার এক নবাব এক বাঙালি বাবুকে নাকি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন এক বাঘিনির সঙ্গে লড়াই করার জন্য। সেই যুবক প্রবেশ করলেন বাঘিনির খাঁচায়। শুরু হল লড়াই। দীর্ঘ ক্ষণ চলল বাঘে-মানুষে কুস্তি। বাঘিনির আঁচড়-কামড়ে যুবক ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু, শেষমেশ তাঁরই জয় হল। বাঘিনি এক সময় রণে ভঙ্গ দিল। উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা। নবাব সেই যুবককে নগদ দু’হাজার টাকা, দু’টি আরবি ঘোড়া এবং সেই সঙ্গে বাঘিনিটিকেও পুরস্কার হিসাবে দিলেন। যুবকের নাম শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
শ্যামাকান্তের নাম আজকের প্রজন্মের বাঙালির কাছে প্রায় অশ্রুত। বিচিত্র এক জীবন যাপন করেছিলেন উনিশ শতকের এই মানুষটি। এক সময় সন্ন্যাসও নেন শ্যামাকান্ত। সন্ন্যাসী অবস্থায় তাঁর নাম হয় সোহং স্বামী।
শ্যামাকান্তের জন্ম ১৮৫৮ সালে, মহাবিদ্রোহের এক বছর পরে। তিনি জন্মছিলেন সাবেক ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের অড়িয়ল নামের এক গ্রামে। শ্যামাকান্তের বাবা শশিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রিপুরার মুরাদনগরের আদালতে সেরেস্তাদারের কাজ করতেন। শ্যামাকান্তেরা চার ভাই ও তিন বোন। শ্যামাকান্তই ছিলেন জ্যেষ্ঠ।
শ্যামাকান্তের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের পাঠশালায় শুরু হলেও পরে তাঁকে বাবার কর্মস্থলের এক স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পড়তে আসেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন শ্যামাকান্ত। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের জিমিন্যাশিয়ামে নিয়মিত শরীরচর্চা শুরু করেন।
এই সময়েই সহপাঠী পরেশনাথ ঘোষের সঙ্গে তিনি এক কুস্তির আখড়ায় যাতায়াত শুরু করেন এবং অচিরেই কুস্তিগির হিসাবে সুনাম লাভ করেন। বেশ কিছু নামজাদা পালোয়ানকে তিনি কুস্তিতে পরাজিত করেন।
সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শ্যামাকান্ত। কিন্তু ব্রিটিশ রাজের সেই প্রাথমিক জমানায় বাঙালির জন্য সেনাবাহিনীর পথ তেমন সুগম ছিল না। শ্যামাকান্ত ও পরেশনাথ স্থির করেন, তাঁরা কোনও দেশীয় রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। এই উদ্দেশ্যে বন্ধু পরেশনাথের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য ঘুরে দেখেন। কিন্তু দেশীয় রাজ্যগুলির সেনাবাহিনীতে দাসত্বপরায়ণতা ও দুর্নীতি দেখে তাঁরা আশাহত হন। শ্যামাকান্ত এর পরে বাংলায় ফিরে আসেন। এই সময়েই তাঁর বিয়ে হয়।
বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে শ্যামাকান্ত ত্রিপুরা ভ্রমণ করেন। ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য তাঁর ব্যায়ামপুষ্ট শরীর এবং অন্যান্য গুণ দেখে তাঁকে তাঁর পার্শ্বচর হিসাবে নিযুক্ত করেন।
বীরচন্দ্রের পার্শ্বচর থাকাকালীন এক বার এক শিকার অভিযানে তাঁরা বাঘের কবলে পড়েন। শ্যামাকান্ত খালি হাতে বাঘটির সঙ্গে লড়াই শুরু করেন। তাকে ধরাশায়ী করে শেষমেশ হত্যাও করেন। শ্যামাকান্তের বীরত্ব দেখে রাজা আপ্লুত হয়ে পড়েন।
কিন্তু শ্যামাকান্ত দীর্ঘ দিন রাজার পার্শ্বচরের কাজ করার মানুষ ছিলেন না। কোনও কারণে বীরচন্দ্রের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দেন। এর পর বরিশাল জেলা স্কুলে ব্যায়াম শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। এই সময় থেকেই তিনি একটি সার্কাসের দল গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সার্কাস তৈরির উদ্দেশ্যেই তিনি শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জ থেকে একটি চিতাবাঘ কেনেন।
চিতাবাঘটিকে বশ করার জন্য শ্যামাকান্ত রোজ তার খাঁচায় ঢুকে পড়তেন। তার পরে তার সঙ্গে শুরু হত তাঁর ধস্তাধস্তি। দু’মাস ধরে এমন চলার পর শেষমেশ তিনি চিতাবাঘটিকে বশ করতে সমর্থ হন। ক্রমে অন্য হিংস্র পশুদেরও বশ করার কাজে তিনি লেগে পড়েন। কার্যত, হিংস্র পশুকে পোষ মানানো শ্যামাকান্তের একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়।
বাঘের সঙ্গে লড়তে পারেন বলে শ্যামাকান্তের খ্যাতি তখন বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। এমন সময় ভাওয়ালের রাজা তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার উপহার দেন। শ্যামাকান্ত সেই বাঘের নাম রাখেন ‘গোপাল’। প্রায়শই এই গোপালের সঙ্গে কোস্তাকুস্তি করতে দেখা যেত তাঁকে। খেলাচ্ছলে শ্যামাকান্ত তার মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিতেন। গোপালও সুবোধ বালকের মতো সেই হাতে মনের সুখে কামড় বসাত। তার পরে শ্যামাকান্ত হাসিমুখেই তাঁর ক্ষতবিক্ষত হাতটি বার করে আনতেন।
বাঘের সঙ্গে এমন খেলা দেখানোর ব্যাপারে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন শ্যামাকান্ত। বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে দেশীয় রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই খেলা দেখিয়ে বেড়াতে শুরু করেন।
১৮৯৪ সাল নাগাদ শ্যামাকান্ত ১৫০০ টাকা বেতনে ফ্রেডকুক নামের এক ইংরেজ সাহেবের সার্কাসে হিংস্র পশুর খেলা দেখানোর কাজ নেন। কিন্তু পরের বছরই সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের সার্কাস দল খোলেন।
১৮৯৭ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে শ্যামাকান্তের সার্কাস দল খেলা দেখিয়ে বেড়াত। কিন্তু সে বছর রংপুরে এক ভূমিকম্পে তাঁর সার্কাস ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু পশু মারাও যায়। কেবল দু’টি বাঘ সেই বিপর্যয়ে বেঁচে গিয়েছিল। শ্যামাকান্ত কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সেই দু’টি বাঘকে নিয়ে একাই খেলা দেখাতে শুরু করেন। এই পর্যায়ে তিনি হাতি, বাঘ, বানর, কুকুর প্রভৃতি প্রাণী নিয়ে ‘গ্র্যান্ড শো অফ ওয়াইল্ড অ্যানিম্যালস’ নামের এক নতুন ধরনের খেলা দেখাতে শুরু করেন। সেই খেলাও জনপ্রিয়তা পায়।
বাল্যকাল থেকেই শ্যামাকান্তের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ লক্ষ করা গিয়েছিল। শৈশবে বাবার কর্মস্থল ত্রিপুরায় থাকাকালীন তিনি এক সন্ন্যাসীর সংস্পর্শ আসেন। তাঁর প্রভাবেই নাকি শ্যামাকান্তের মনে ধর্মভাবের উদয় হয়। ১৮৯৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর, ৪২ বছর বয়সে শ্যামাকান্ত গৃহত্যাগ করেন। তত দিনে তিনি পিতাও হয়েছেন।
পরিব্রাজক শ্যামাকান্ত বিভিন্ন তীর্থ ঘুরে হিমালয়ে পৌঁছন। সেখানে এক সাধকের কাছে তিনি দীক্ষা নিতে চান। কিন্তু সেই সাধক তাঁকে কাশীতে বসবাসরত ‘তিব্বতিবাবা’ হিসাবে পরিচিত এক সন্ন্যাসীর কাছে পাঠান। তিব্বতিবাবার পূর্বাশ্রমের নাম নবীনচন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি শ্রীহট্টের বাসিন্দা ছিলেন। পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তিনি পরিভ্রমণ করেছিলেন। তিব্বতে ৩২ বছর বাস করে সাধনা করেছিলেন বলে সন্ন্যাসী জগতে তিনি ‘তিব্বতিবাবা’ নামে পরিচিত হন।
তিব্বতিবাবা শ্যামাকান্তকে সন্ন্যাসদীক্ষা দান করেন। শ্যামাকান্ত ‘সোহং স্বামী’ নামে পরিচিত হন। ছ’মাস কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন করেন। পরে গুরুর নির্দেশে তিনি নৈমিষারণ্যে নির্জন সাধনা সম্পন্ন করেন। পরে আবার হিমালয়ে ফিরে যান এবং নৈনিতালের কাছে ভাওয়ালী নামে এক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই সাধনা করতে থাকেন।
ভাওয়ালীর আশ্রমে সোহং স্বামী নামে বেশ কিছু গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। পরে সেগুলি প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে ‘সোহং গীতা’, ‘সোহং সংহিতা’, ‘সোহং তত্ত্ব’, ‘কমন সেন্স’ উল্লেখযোগ্য।
সন্ন্যাসজীবনেও শ্যামাকান্ত বেশ পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং নিরালম্ব স্বামী নামে পরিচিত হন।
১৯১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর শ্যামাকান্ত তথা সোহং স্বামী ভাওয়ালীর আশ্রমেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর গুরু তিব্বতিবাবার নির্দেশে তাঁর দেহাস্থি বর্ধমানের পালিতপুরের এক আশ্রমে সমাহিত করা হয়।