এক দিকে বিস্তৃত সাগর। অন্য দিকে রয়েছে উপসাগর। দুই বিস্তীর্ণ জলরাশির সংযোগস্থলে একটি ক্ষুদ্র মহাদেশ (মাইক্রোকন্টিনেন্ট)-এর সন্ধান পেয়েছেন ভূতত্ত্ববিদেরা। বরফের স্তরের নীচে লুকোনো এই ভূমিস্তরের বয়স নাকি ছ’কোটি বছরের কাছাকাছি।
গ্রিনল্যান্ড এবং কানাডার মধ্যে অবস্থিত ল্যাব্রাডর সাগর এবং ব্যাফিন উপসাগরকে সংযুক্ত করে ডেভিস প্রণালী। এই নির্দিষ্ট অঞ্চলের জটিল ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দীর্ঘ দিন ধরে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের ডার্বি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদের একটি দল ডেভিস প্রণালীতে পুরু মহাদেশীয় ভূত্বকের একটি বিচ্ছিন্ন ভূমিস্তর শনাক্ত করেছে। ১৯ থেকে ২৪ কিলোমিটার পুরু এই ভূমিস্তরটি সম্ভবত গ্রিনল্যান্ড থেকে প্রান্ত বরাবর পূর্ব-পশ্চিম দিকে সম্প্রসারণের কারণে গঠিত হয়েছিল।
সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, গ্রিনল্যান্ড এবং কানাডার মধ্যবর্তী অঞ্চলে টেকটনিক প্লেটের জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিমজ্জিত থাকা একটি ভূমিস্তরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যা উত্তর আটলান্টিকের মহাদেশ গঠনের বিষয়ে আলোকপাত করে।
ব্রিটেন এবং সুইডেনের বিজ্ঞানীরা কানাডা এবং গ্রিনল্যান্ডের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে সমুদ্রগর্ভে গবেষণা করতে শুরু করেছিলেন। স্যাটেলাইট থেকে সংগৃহীত মাধ্যাকর্ষণজনিত তথ্য এবং জাহাজ থেকে পাওয়া ‘সিসমিক রিডিং’-এর সাহায্যে এই ক্ষুদ্র মহাদেশের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
মহাকর্ষীয় তথ্য সমুদ্রপৃষ্ঠের গভীরে পাথরের ঘনত্ব বুঝতে সাহায্য করে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে সমুদ্রের গভীরে হওয়া ছোট ছোট পরিবর্তনগুলি লক্ষ করা হয়।
অন্য দিকে, ভূকম্পীয় তথ্য গভীর শিলাস্তর এবং তার কাঠামোর পরিবর্তন লক্ষ করার জন্য শব্দতরঙ্গের (অ্যাকাউস্টিক ওয়েভ) প্রতিফলন ব্যবহার করে।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানা ধরনের কম্পিউটার মডেল তৈরি করা হয়। সেগুলির সাহায্যে ডেভিস প্রণালীর ভূত্বক পর্যবেক্ষণ করা হয়।
গবেষণা করে জানা গিয়েছে যে, গ্রিনল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকা প্রায় ১২ কোটি বছর আগে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। টেকটনিক প্লেটের এই গতিবিধি প্রায় ৬ কোটি ১০ লক্ষ বছর আগে আরও বেড়ে যায়। ডেভিস প্রণালীর সমুদ্রতল আরও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং বর্তমান কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে।
ক্ষুদ্র মহাদেশ গঠনের কারণ হিসাবে গ্রিনল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যবর্তী ফাটল এবং সমুদ্রতল বিস্তারকে দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। গ্রিনল্যান্ডের প্রান্ত বরাবর পূর্ব-পশ্চিম সম্প্রসারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় এই মহাদেশীয় গঠনকে বিচ্ছিন্নতার দিকে চালিত করে।
গবেষকদলের দাবি, গ্রিনল্যান্ড সম্ভবত সান আন্দ্রেয়াসের মতো চ্যুতির উপর দিয়ে চলাচল করছিল যা প্রি-উঙ্গাভা ট্রান্সফর্ম মার্জিন নামে পরিচিত। এটি টেকটনিক প্লেটের চলাচলের পথকে আরও উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
প্রায় ছ’কোটি বছর আগে প্লেটগুলি আরও উত্তর দিকে সরে যায় এবং ঘটনাক্রমে ক্ষুদ্র মহাদেশ গঠিত হয়। ভূতত্ত্ববিদেরা এই ক্ষুদ্র মহাদেশের নাম দিয়েছেন ডেভিস প্রণালী প্রোটো-মাইক্রোকন্টিনেন্ট।
বর্তমানে অবশ্য এই ক্ষুদ্র মহাদেশটি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। কোনও বড় ধরনের ভূমিকম্প অথবা প্লেটের ন্যূনতম চলাচল লক্ষ করা যায়নি এই অঞ্চলে। প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে উত্তর আমেরিকার প্লেটটি ভেঙে যাওয়া শুরু হয়। তার পর অবশ্য এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায় এবং এই অঞ্চলে একটি নতুন চ্যুতি তৈরি হয় যা ডেভিস প্রণালীতে ফাটল ধরানো বন্ধ করিয়ে দেয়।
৩ কোটি বছর আগে এলেসমেয়ার দ্বীপের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় গ্রিনল্যান্ডের ভূস্তর, যা সম্ভবত টেকটনিক প্লেটের গতিবিধি আরও ধীর করে দেয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে একই রকম ভূতাত্ত্বিক কাঠামো পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আইসল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে জান মায়েন ক্ষুদ্র মহাদেশ, তাসমানিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে পূর্ব তাসমান রাইজ় এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ান উপকূলে গুলডেন ড্রাক নল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ধরনের মহাদেশীয় গঠন সম্পর্কে পরীক্ষা করার জন্য ডেভিস প্রণালী প্রোটো-মাইক্রোকন্টিনেন্ট আদর্শ প্রাকৃতিক পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে।