আমেরিকা হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। তাতে যথারীতি কান দেননি তিনি। যা করার, করলেন তা-ই। সদলবলে রাশিয়ায় হাজির হলেন উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন। নিজের সেই পরিচিত ট্রেনে চেপে। এমনটাই জানিয়েছে জাপানের সংবাদমাধ্যম। এই ট্রেনে চেপেই অতীতে ভিয়েতনাম, চিনে গিয়েছিলেন কিম। এ বার সেই ট্রেনেই গন্তব্য রাশিয়া। তবে কি অস্ত্র বিক্রি নিয়ে চুক্তিই উদ্দেশ্য?
রাশিয়ায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নাকি বৈঠক করার কথা কিমের। সে কারণে রবিবার উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং ছেড়েছিলেন কিম সেই ট্রেনে চেপে। এমনটাই জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম।
জাপানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সেই ট্রেন ইতিমধ্যে রাশিয়ার পূর্বে খাসান স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছে। উত্তর কোরিয়া থেকে রাশিয়ার পূর্ব দিকে প্রবেশের পথ হল এই খাসান স্টেশন। জাপানের সংবাদমাধ্যমকে এই খবর দিয়েছে রাশিয়ার একটি সূত্র। খাসানের প্রশাসন যদিও এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
মঙ্গলবার ভ্লাদিভস্তোকে পৌঁছনোর কথা পুতিনের। সেখানে ‘ইন্টার্ন ইকোনমিক ফোরাম’-এর সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা তাঁর। সেই সম্মেলনের পাশাপাশি কিমের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথাও রয়েছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকোভ জানান, দুই পক্ষের আলোচনা চলবে। তাতে কাজ না হলে একে অপরের সঙ্গে কথা বলবেন রাষ্ট্রনেতারা। উত্তর কোরিয়ার তরফে কিছু জানানো হয়নি এই বিষয়ে।
আমেরিকা অবশ্য অনেক দিন ধরেই দাবি করে চলেছে যে, রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বসছে উত্তর কোরিয়া। ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়েই কথা বলবে তারা।
আমেরিকার এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে মস্কো এবং পিয়ংইয়ং। উত্তর কোরিয়া জানিয়েছে, ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে তারা অস্ত্র জোগাচ্ছে না। গত ১৮ মাস ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে রাশিয়া।
উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, কিমের সঙ্গে ট্রেন সফরে গিয়েছেন শাসকদলের নেতা, প্রশাসনিক এবং সেনাকর্তারা। সূত্রের খবর, কিমের সফরসঙ্গী হয়েছেন জো চুন রিওং। এই রিওং উত্তর কোরিয়া সরকারের অস্ত্রশিল্প বিভাগের প্রধান।
তার পরেই আমেরিকা এবং জোটসঙ্গীদের আশঙ্কা, রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহই কিমের উদ্দেশ্য। সে কারণেই সম্প্রতি দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। ২০১৯ সালের পর ফের এখন পুতিনের সঙ্গে দেখা করছেন কিম।
সোমবার কিমের ট্রেন রাশিয়ার কাছাকাছি পৌঁছতেই নতুন করে হুঁশিয়ারি দেয় ওয়াশিংটন। জানিয়ে দেয়, কোনও ভাবেই ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে না।
আমেরিকার বিদেশ দফতর জানায়, রাশিয়াকে যুদ্ধের জন্য কিমের দেশ অস্ত্র বিক্রি করলে তা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবকে লঙ্ঘন করবে। এই প্রস্তাবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অস্ত্রের লেনদেন নিষিদ্ধ।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা করে রাশিয়া। তাদের সমর্থন করে একমাত্র উত্তর কোরিয়া। এর পর ক্রমেই কাছাকাছি এসেছে দুই দেশ। গত জুলাই মাসে পিয়ংইয়াং গিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরগেই সোইগু। শোনা যাচ্ছে, তাঁর জন্য অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন কিম।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকোভ এ বার স্পষ্টই বলেন, ‘‘আমাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত করব।’’ আর তা করতেই পিয়ংইয়ং থেকে ট্রেনে চেপে চলে এলেন কিম। গুটিকয়েক যে বন্ধুরাষ্ট্র রয়েছে উত্তর কোরিয়ার, সেখানে এই ট্রেনে চেপেই যান কিম।
২০১৯ সালে এই বিলাসবহুল ট্রেনে চেপেই ভিয়েতনামের হ্যানয় পৌঁছেছিলেন কিম। হলুদ ডোরাকাটা গাঢ় সবুজ রঙের ট্রেনটি বিলাসবহুল হোটেলের থেকে কম নয়। উত্তর কোরিয়া সরকারেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, কিমের বিলাসবহুল জীবনযাপনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ ট্রেন।
২১ কামরার সেই ট্রেনে রয়েছে অনেকগুলি বিলাসবহুল ঘর। ঘরগুলির বেশির ভাগের মধ্যে রয়েছে গোলাপি চামড়ায় মোড়া বড় বড় চেয়ার, জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন। ট্রেনের কামরাগুলি হালকা গোলাপি রঙের পর্দায় মোড়া।
ট্রেনে রয়েছে সুবিশাল খাবার জায়গা। ঘুমানোর জন্য আলাদা ঘর। একটি কামরায় নাকি রয়েছে বিলাসবহুল গাড়ির সম্ভার। রয়েছে স্যাটেলাইট ফোনের ব্যবস্থাও, প্রয়োজনে দেশের আধিকারিকদের সঙ্গে যাতে দ্রুত পরামর্শ সারতে পারেন কিম।
তার আগে চিনেও গিয়েছিলেন কিম এই ট্রেনে চড়ে। তবে একা কিম নন, তাঁর বাবাও নাকি বিদেশ সফরে যেতেন ট্রেনে চেপেই। প্রয়াত শাসক কিম জং ইল নাকি আকাশপথে ভয় পেতেন। ১৯৯৪-২০১১ সালের শাসনকালে কিমের বাবা সাত বার চিন সফরে যান। আর রাশিয়ায় যান তিন বার।
গোটা ট্রেন ইস্পাতের পাতে মোড়া এবং বুলেটপ্রুফ। ভারী হওয়ার কারণে গতি কখনওই ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি হয় না। জরুরি অবস্থার কথা ভেবে নাকি সশস্ত্র অন্য যান এবং হেলিকপ্টারও থাকে ট্রেনে।
উত্তর কোরিয়ার সরকারি সূত্রের দাবি, এমন ট্রেনেই ২০১১ সালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কিম জং ইল। কিম শাসকদের হেফাজতে একই রকম দেখতে নাকি বেশ কয়েকটি ট্রেন রয়েছে। পিয়ংইয়ংয়ের বিশেষ কারখানায় তৈরি হয় সেগুলি। কিমের ঠাকুরদা কিম ইল সাং-ও এই ভাবেই সফর করতেন। এ বার কিং সেই ট্রেনে চেপেই রাশিয়ায়। উদ্দেশ্য কি অস্ত্র বিক্রি?