কেরলে নরবলি-কাণ্ডে পরতে পরতে রহস্য। তদন্ত যতই এগোচ্ছে, উঠে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ধনসম্পত্তি বাড়াতে দুই মহিলাকে বলি দেওয়ার ঘটনায় উত্তাল গোটা রাজ্য। ইতিমধ্যেই মূল অভিযুক্ত মহম্মদ শফীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আটক করেছে অভিযুক্ত দম্পতি ভগবল সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী লায়লাকে।
পুলিশ সন্দেহ করছে, শুধু বলি দেওয়াই নয়, দুই মহিলার মাংসও খেয়েছেন অভিযুক্তরা। তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, দুই মহিলা রোসেলিন (৪৯) এবং পদ্মাকে (৫২) পর্নোগ্রাফি এবং টাকার লোভ দেখিয়ে তুলে নিয়ে এসেছিলেন শফী। তার পর সিংহ দম্পতির বাড়িতে তাঁদের আটকে রাখা হয়।
পুলিশ আরও জানতে পেরেছে যে, প্রথমে দুই মহিলার হাত-পা বাঁধা হয়। তার পর তাঁদের গলা টিপে খুন করে স্তন কেটে দেওয়া হয়। শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার পর দুই মহিলার দেহ টুকরো টুকরো করে কাটা হয়। পুলিশের সন্দেহ, তন্ত্রমন্ত্রের দোহাই দিয়ে সেই মাংস রান্না করেও খেয়েছেন অভিযুক্তরা।
পুলিশ বলছে, এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত মহম্মদ শফী। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং প্রতারণার একাধিক মামলা রয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বেছে বেছে পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলাদেরই তাঁর লালসার শিকার বানাতেন। নরবলি-কাণ্ডে যে দু’জন মহিলাকে শিকার বানিয়েছিলেন, তাঁদের দু’জনের বয়সই পঞ্চাশ।
শুধু ধর্ষণ বা প্রতারণাই নয়, মাদক পাচার চক্রের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন শফী। কোনও একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশি দিন থাকতেন না গ্রেফতারির ভয়ে। যেখানেই যেতেন, সেখানে নিজেকে রশিদ নামে পরিচয় দিতেন।
পুলিশ জানিয়েছে, শফীর যৌন এবং মানসিক বিকৃতি রয়েছে। যাঁদের শিকার বানাতেন, তাঁদের উপর শারীরিক অত্যাচার করে আনন্দ পেতেন। দুই মহিলাকে বলি দেওয়ার আগে তাঁদের উপর যৌন নির্যাতনও করেছেন শফী।
শফির বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং প্রতারণার আটটি মামলা চলছে। ২০২০ সালে ৭৫ বছরের এক মহিলাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেন শফী। তাঁর যৌনাঙ্গে লোহার রডও ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেই ঘটনায় এক বছর জেল খেটেছেন। বর্তমানে জামিনে ছিলেন।
শফী নিজেকে তান্ত্রিক বলে পরিচয় দিতেন। শুধু তা-ই নয়, আর্থিক হোক বা পারিবারিক— সব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারেন, এই টোপ দিয়ে নিজের জালে ফাঁসাতেন। ঠিক যেমন ভাবে দুই দম্পতিকে ধনসম্পত্তি বৃদ্ধির জন্য নরবলির পরামর্শ দিয়েছিলেন শফী।
পুলিশ জানিয়েছে, সমাজমাধ্যমেও যথেষ্ট সক্রিয় শফী। ভুয়ো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বানিয়ে আর্থিক সমস্যায় থাকা লোকজনদের নিজের জালে ফাঁসাতেন। তাই ফেসবুকে তিনি লিখতেন, কেউ কোনও আর্থিক সমস্যায় পড়লে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
কেরলের সিংহ দম্পতির সঙ্গেও এই একই কারণ নিয়ে ফেসবুকে আলাপ হয় শফীর। নিজেকে তাঁদের কাছে ‘শ্রীদেবী’ নামে পরিচয় দিয়েছিলেন ফেসবুকে।
কোচি সিটি পুলিশ কমিশনার এইচ নাগরাজু বলেন, “সিংহ দম্পতিকে নিজের জালে ফাঁসাতে তিন বছর সময় লেগেছিল শফীর।”
পুলিশের কাছে অভিযুক্ত লায়লা (ভগবল সিংহের স্ত্রী) দাবি করেছেন, শফি তাঁর স্বামীর সামনেই লায়লাকে ধর্ষণ করতেন তন্ত্রসাধনার দোহাই দিয়ে। ভগবলকে এ কথা শফী বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, লায়লার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাঁদের বিত্তশালী হওয়ার পথ আরও সহজ হবে।
তদন্তে পুলিশ আরও জানতে পেরেছে যে, লায়লাকে যখন ধর্ষণ করতেন তখন স্বামী ভগবল সিংহ সেই ঘটনাকে তন্ত্রসাধনার একটি অঙ্গ হিসাবে ভেবে করজোড়ে সেই ঘটনা চাক্ষুষ করতেন।
পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, নিজের লালসা মেটানোর আগে মহিলাদের উপর শারীরিক অত্যাচার করতেন শফী। স্রেফ আনন্দ পাওয়ার নেশায় তাঁদের খুন করতেও দ্বিধা করতেন না শফী।
রোসেলিন এবং পদ্মার দেহ থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে, এই দৃশ্য দেখেও শফি প্রচণ্ড উত্তেজিত ছিলেন। জেরায় এমনটাই জানতে পেরেছে পুলিশ।
তামিলনাড়ুর এর্নাকুলাম জেলার পেরুম্ভাবুরের বাসিন্দা শফী। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। নাবিসা নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেছেন শফী। তাঁদের দুই মেয়ে। এক মেয়ের আবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাঁর এক সন্তানও আছে।
লরিচালক থেকে মেকানিক— সব রকম কাজ করতেন শফী। সম্প্রতি কোচিতে একটি হোটেলও খুলেছেন। এই হোটেলেই তাঁর শিকার তুলে নিয়ে আসতেন। মূলত বিধবা, আর্থিক অনটনে জর্জরিত, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই— এমন মহিলাদের নিজের জালে ফাঁসাতেন শফী।
শফীর স্ত্রী নাবিসা পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, শফীর কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। বাড়িতেও টাকা দিতেন না। সমস্ত টাকা মদ্যপান করেই উড়িয়ে দিতেন।
নাবিসার আরও অভিযোগ, তাঁর ফোন এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতেন শফী।