যে কোনও দেশের উন্নয়নের মূলে রয়েছে আর্থিক উন্নতি এবং দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। এই দু’টির অনেকাংশ নির্ভর করে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে নির্দিষ্ট দেশটির বাণিজ্য এবং যোগাযোগের উপর।
দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায় কোনও সম্মেলনে একাধিক দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার গতিপ্রকৃতি দেখে।
ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্ক কেমন? প্রতিবেশীদের মধ্যে গুরুত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে কী ভাবছে ভারত? এই বিষয়গুলি বোঝার ক্ষেত্রে বিমস্টেক আর সার্ক সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।
‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক কোঅপারেশন’ বা সংক্ষেপে বিমস্টেক হল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কয়েকটি দেশকে নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক জোট।
বিমস্টেক অঞ্চলের জনসংখ্যা ১৭০ কোটি। এটি পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ। বিমস্টেকের জিডিপি পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশি।
১৯৯৭ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও তাইল্যান্ডের বিদেশমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে ব্যাঙ্ককে একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে একটি নতুন আন্তঃআঞ্চলিক জোট তৈরি হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির নামের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী এই জোটের নাম হয় বিস্টেক। বিস্টেক এর পুরো নাম বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, তাইল্যান্ড ইকনমিক কোঅপারেশন।
মায়ানমার এই সভায় পর্যবেক্ষক হিসাবে অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর মায়ানমারকে পূর্ণ সদস্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তার পর সংগঠনের নামটি কিছুটা পরিবর্তন করে বিমস্টেক করা হয়।
২০০৩ সালে নেপাল ও ভুটান বিমস্টেকের সদস্য হয়। ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই সংগঠনটির পরিবর্তিত নাম হয় বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন সংক্ষেপে বিমস্টেক।
বিমস্টেকের মূল উদ্দেশ্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশগুলির মধ্যে প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা। ব্যবসা, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, পর্যটন, মানবসম্পদ, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পোশাক ও চামড়া শিল্প-সহ আরও অনেক ক্ষেত্রের উন্নয়ন বিমস্টেকের লক্ষ্য।
দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশ (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দু’টি দেশ (মায়ানমার, তাইল্যান্ড) বিমস্টেকের সদস্য।
২০২২ সালের ৩০ মার্চ বিমস্টেকের কলম্বো শীর্ষ সম্মেলন হয় ভার্চুয়াল মাধ্যমে। এই সম্মেলনে সাতটি ক্ষেত্রে সাতটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলা হয়। বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের দায়িত্বে বাংলাদেশ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত দায়িত্বে ভুটান, নিরাপত্তা ও শক্তিবৃদ্ধির দেখভালের দায়িত্বে ভারত, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার দায়িত্বে মায়ানমার, মানুষে মানুষে যোগাযোগের দায়িত্বে নেপাল, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের দায়িত্বে শ্রীলঙ্কা এবং সংযোগের দায়িত্বে তাইল্যান্ড।
বিমস্টেকের সদস্যদের মধ্যে বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা হয়েছে। বিমস্টেকের সর্বশেষ সম্মেলন হয় শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের ৩০ মার্চ। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চলকে শান্তিপূর্ণ রাখা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এবং জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতি।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তাইল্যান্ডে বিমস্টেকের সম্মেলন হওয়ার কথা। সম্প্রতি বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বিমস্টেকের পরবর্তী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে কিছু মতামত দিয়েছেন।
আগামী দিনে সদস্য দেশগুলির মধ্যে এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে বিমস্টেকের পরিধি বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানিয়েছেন জয়শঙ্কর।
বিশ্ব এবং আঞ্চলিক স্তরে উন্নয়নের কথা বলেছেন জয়শঙ্কর। জয়শঙ্কর বলেন, বিমস্টেকের সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে বিমস্টেকের সদস্য দেশগুলির সমস্যা সমাধান সহজতর হবে।
কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি এবং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যের কথা বলেছেন জয়শঙ্কর। এর মধ্যে রয়েছে সক্ষমতা তৈরি করা (ক্যাপাসিটি বিল্ডিং) এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টিতে জয়শঙ্কর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বিমস্টেকের সদস্য দেশগুলির মধ্যে আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন জয়শঙ্কর।
শুধুমাত্র অর্থনীতি আর প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে বাণিজ্যের পরিধি বিস্তার করার কথাও বলেছেন জয়শঙ্কর।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, সীমান্তে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং জনজাতির পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে নজর দেওয়ার কথাও বলেছেন জয়শঙ্কর।
আগে বিমস্টেক কেবল প্রযুক্তি এবং আর্থিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে স্বাস্থ্য, মহাকাশ গবেষণা, ডিজিটাল পরিকাঠামো এবং সামাজিক আদানপ্রদানের প্রতি নজর দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন, ভারত কেন সার্ক ছেড়ে বিমস্টেকের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে? সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিয়োনাল কোঅপারেশন (সার্ক) দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। সার্কের সদস্য আট দেশ হল ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মলদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তান।
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সার্কের উদ্দেশ্য। আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সহায়তা প্রদান এর মূল লক্ষ্য।
২০১৪ সালে ২৬ আর ২৭ নভেম্বর ১৮তম সার্ক সম্মেলন নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৮টি দেশ অংশ নিয়েছিল। এর পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ১৯তম সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও সেটি বাতিল হয়। বর্তমানে সার্কের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। সার্কের আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা— এই পাঁচ দেশ বিমস্টেকের সদস্য।
বিমস্টেকের সদস্য দেশগুলি বঙ্গোপসাগরের আশপাশে অবস্থিত। এই বৃহত্তর অঞ্চলে জমি বা সীমান্ত সংক্রান্ত বিবাদ নেই বললেই চলে। এখানে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতিই লক্ষ্য। চিন এবং পাকিস্তানও এই গোষ্ঠীর সদস্য নয়। এই কারণেই ভারত সার্ক ছেড়ে বিমস্টেকের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যোগাযোগ ও বাণিজ্য বিস্তার, সংস্কৃতির বিকাশ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা, বিমস্টেকের মাধ্যমে এই চার বিষয় লক্ষ্য রাখছে ভারত।
বিমস্টেক সফল হলে ভারত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারবে বলা যেতে পারে। এক দিকে দেশীয় অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠবে। অন্য দিকে বিমস্টেকের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের অবস্থান জোরালো হবে।