ভারত ও আমেরিকাকে একসঙ্গে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লাগাতার নৌশক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে চিন। প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে বেজিংয়ের যুদ্ধজাহাজ মাঝেমধ্যেই ‘দাদাগিরি’ দেখাতে চলে আসছে ভারত মহাসাগরে। চুপ করে বসে নেই নয়াদিল্লিও। সাম্প্রতিক সময়ে জলফৌজের শক্তিবৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
বর্তমানে চিনের হাতে রয়েছে দু’টি বিমানবাহী রণতরী। সমসংখ্যক বিমানবাহী যুদ্ধপোত রয়েছে ভারতীয় নৌসেনার কাছেও। যার একটির নাম আইএনএস বিক্রমাদিত্য ও আইএনএস বিক্রান্ত।
দু’টি যুদ্ধপোতের মধ্যে আইএনএস বিক্রমাদিত্যের নৌসেনায় যুক্ত হওয়ার কাহিনি কোনও রূপকথার চেয়ে কম নয়। সোভিয়েত যুগের রণতরীটি পরবর্তী কালে কিনে নেয় নয়াদিল্লি। তার পর চলে সংস্কারের কাজ। ২০১৩ সাল থেকে ভারতীয় নৌসেনার হয়ে সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই রণতরী।
সোভিয়েত যুগে তৈরি হয়েছিল আইএনএস বিক্রমাদিত্য। ওই সময়ে এর নাম ছিল ‘বাকু’। ১৯৮৭ সালে যার ব্যবহার শুরু করে সোভিয়েত নৌসেনা। এর তিন বছরের মাথায় অবশ্য ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত।
সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর ‘বাকু’ চলে যায় রুশ নৌসেনার দখলে। তখনই নাম বদল হয় এই বিমানবাহী রণতরীর। রাশিয়ার কিংবদন্তি নৌসেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল গোরশকভের নাম অনুসারে করা হয় এর নতুন নামকরণ। সালটা ছিল ১৯৯১।
১৯৯৬ সালে ‘অ্যাডমিরাল গোরশকভ’-কে ‘স্বেচ্ছাবসরে’ পাঠায় রুশ নৌসেনা। বিমানবাহী রণতরীটি পুরনো হয়ে গিয়েছিল, এমনটা নয়। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর নৌবাহিনীর খরচ কমাতে চাইছিল মস্কো। সেই জায়গা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাশিয়া।
‘অ্যাডমিরাল গোরশকভ’-এর অবসরের খবর পেয়েই তা কিনে নেওয়ার জন্য মস্কোর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দেয় নয়াদিল্লি। বিমানবাহী রণতরীটির দাম নিয়ে চলে দর কষাকষি। শেষে ২০০৪ সালের ২০ জানুয়ারি ভারতের হাত আসে ওই যুদ্ধপোত।
মস্কোর থেকে বিমানবাহী রণতরীটি কিনে নেওয়ার পর এর মেরামত শুরু করে ভারতীয় নৌসেনা। রাশিয়ারই ওয়ার্কশপে চলে এর সংস্কার। যা শেষ হওয়ার পর সমুদ্রে নামিয়ে এর শক্তিপরীক্ষা করে নৌসেনা। শেষে ২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর এটিকে বাহিনীতে যুক্ত করা হয়।
রুশ বন্দর শহর সেভেরোডভিনস্কে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘অ্যাডমিরাল গোরশকভ’-কে ভারতীয় নৌসেনার হাতে তুলে দেয় মস্কো। সেখান থেকে রণতরীটিকে নিজেদের নৌঘাঁটিতে নিয়ে আসে নয়াদিল্লি। এর নতুন নাম দেওয়া হয় ‘আইএনএস বিক্রমাদিত্য’। ২০১৪ সালের ১৪ জুন নৌসেনার হাতে ওই যুদ্ধপোতটি তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, এক রকম বিনামূল্যেই রাশিয়ার থেকে ওই যুদ্ধজাহাজ পেয়েছিল নয়াদিল্লি। তবে এর সংস্কারের জন্য খরচ হয়েছিল আনুমানিক ৮০ কোটি ডলার। এ ছাড়া রণতরীটিকে যুদ্ধবিমান ও বিভিন্ন হাতিয়ারে সাজিয়ে তুলতে আরও ১০০ কোটি ডলার খরচ করেছিল নয়াদিল্লি।
নৌসেনার পরিভাষায় আইএনএস বিক্রমাদিত্য কিভ শ্রেণির বিমানবাহী রণতরী। অর্থাৎ, এতে যে যুদ্ধবিমানগুলি ব্যবহার করা হয়, সেগুলির পাখা ভাঁজ করে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। ফলে কিছুটা বড় আকারের যুদ্ধবিমান এই যুদ্ধপোতে ওঠানামা করতে পারে।
আইএনএস বিক্রমাদিত্য কেনার সময় রাশিয়ার সঙ্গে যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছিল, তাতে ১২টি এক আসন বিশিষ্ট ‘মিগ-২৯কে ফালক্রাম ডি’ ও বেশ কয়েকটি দ্বিআসন বিশিষ্ট ‘মিগ-২৯কে কেইউবি’ যুদ্ধবিমানের কথা বলা ছিল। সেগুলি নির্ধারিত সময়েই নয়াদিল্লির হাতে তুলে দেয় মস্কো।
এ ছাড়া ওই রণতরীতে রয়েছে রাশিয়ার তৈরি ছ’টি কামোভ কেএ-৩১ হেলিকপ্টার। যা ডুবোজাহাজ ধ্বংস করতে সিদ্ধহস্ত। যুদ্ধজাহাজটিতে রয়েছে টর্পেডো টিউব, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও কামান যা শত্রু জাহাজ ডোবাতে ব্যবহার করতে পারবে ভারতীয় নৌসেনা।
রণতরী কেনার চুক্তি অনুযায়ী, আইএনএস বিক্রমাদিত্য চালানো এবং সেখান থেকে শত্রুর উপর আঘাত হানার যাবতীয় প্রশিক্ষণ ভারতীয় নৌসেনাকে দিয়েছিল রাশিয়া। পাশাপাশি, এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতেও দায়বদ্ধ মস্কো।
আইএনএস বিক্রমাদিত্যকে হাতে পাওয়ার আগে পর্যন্ত হালকা বিমানবাহী রণতরী ‘আইএনএস বিরাট’ ব্যবহার করত ভারতীয় নৌসেনা। ২০১০ সালে এর অবসর নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নতুন বিমানবাহী যুদ্ধপোত হাতে না পাওয়ায় বিরাটের অবসরের সময় পিছিয়ে দিয়েছিল নৌসেনা।
২০১০-১২ সালে আইএনএস বিরাটকে সংস্কার করে নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলা হয়। ফলে আরও পাঁচ বছর নৌসেনার হয়ে সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল ওই যুদ্ধপোত। শেষে ২০১৭ সালের ৬ মার্চ অবসর নেয় এটি।
অন্য দিকে ২০০৪ সালে নৌসেনার জন্য সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে একটি বিমানবাহী রণতরী তৈরির বরাত পায় কেরলের কোচিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড। ২০২২ সালের ২ সেপ্টেম্বর যা হাতে পেয়েছে ভারতের সমুদ্র প্রহরীরা। দ্বিতীয় যুদ্ধপোতটির নাম ‘আইএনএস বিক্রান্ত’।
ভারতের মাটিতে প্রথম তৈরি হওয়া বিমানবাহী এই রণতরীর জন্য আনুমানিক ২৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে কেন্দ্র। এটি চালানোর জন্য ১ হাজার ৭০০ জন নাবিকের প্রয়োজন হয়। আইএনএস বিক্রান্ত লম্বায় ২৬২ মিটার। সমুদ্রে সর্বোচ্চ ২৮ নট বেগে ছুটতে পারে এটি।
আইএনএস বিক্রান্তের রণসজ্জাও শত্রুর বুক কাঁপিয়ে দেবে। এই যুদ্ধপোত থেকে ওঠানামা করতে পারবে ২৬টি রাফাল এম যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া ৪টি কামোভ এক-৩১, দু’টি ধ্রুব ও চারটি এমএইচ ৬০ হেলিকপ্টার রাখার জায়গা রয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, আগামী দিনে তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী তৈরি করবে ভারত। যার নাম হবে ‘আইএনএস বিশাল’। এই যুদ্ধপোত আইএনএস বিক্রান্তের চেয়েও উন্নত হবে বলে জানা গিয়েছে।