জম্মু-কাশ্মীর সীমান্তে সন্ত্রাস বন্ধ করছে না পাকিস্তান। পশ্চিমের প্রতিবেশীকে উচিতশিক্ষা দিতে তাই এ বার সিন্ধু নদীর জল নিয়ে কড়া অবস্থান নিতে চাইছে ভারত। যা নিয়ে ইসলামাবাদকে ইতিমধ্যেই চিঠি ধরিয়েছে নয়াদিল্লি। পাল্টা জবাব দিয়েছে পাকিস্তানও।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, ৬৪ বছর আগে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া সিন্ধু জলচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই চুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক।
ভারত শেষ পর্যন্ত চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে গেলে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে সেচ মারাত্মক ভাবে মার খাবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কৃষিতে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক দিক থেকে ইসলামাবাদের কোমর ভেঙে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
চলতি বছরের ৩০ অগস্ট সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকিস্তানকে চিঠি পাঠায় ভারত। তাতে এই চুক্তিতে মূলগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সীমান্ত-সন্ত্রাসের প্রভাব চুক্তির উপর পড়তে চলেছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে নয়াদিল্লি।
পাশাপাশি ভারত আরও জানিয়েছে, যে সময়ে চুক্তি হয়েছিল, সেই সময়ের তুলনায় এ দেশের জনসংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে এসেছে আমূল বদল। আর তাই নদীর জল আরও বেশি করে ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা গিয়েছে। চুক্তিতে মূলগত পরিবর্তন করে সেই সুবিধা এ বার পেতে চাইছে নয়াদিল্লি।
সিন্ধু জলচুক্তি হওয়ার পর মোট তিন বার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে পাকিস্তান। এ ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরেই ইসলামাবাদের মদতে উপত্যকায় চলছে সন্ত্রাসবাদ। তা সত্ত্বেও এত দিন এই চুক্তি নিয়ে সে ভাবে উচ্চবাচ্য করেনি ভারত।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিন্ধু চুক্তির পুনর্মূল্যায়ণের জন্য প্রথম বার পাকিস্তানকে নোটিস পাঠিয়েছিল নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদের তরফে সে বার কোনও সাড়া মেলেনি। এ বছরে দ্বিতীয় নোটিস তাই ভারতের তরফে বড় পদক্ষেপের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের পাঠানো নোটিস নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বালোচ জানিয়েছেন, ‘‘সিন্ধু জলচুক্তিকে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা বলে মনে করে। আশা করি আগামী দিনেও ভারত এই চুক্তির শর্তগুলি মেনে চলবে।’’
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু নদীর জল বণ্টন নিয়ে এই চুক্তি সাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের করাচি শহরে গিয়ে এই চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু।
সিন্ধু জলচুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘‘ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদীগুলির জল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা ও বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। সহযোগিতামূলক মনোভাবের উপর ভিত্তি করে এই চুক্তি তৈরি করা হয়েছে।’’
সিন্ধু নদীর উৎপত্তি দক্ষিণ পশ্চিম তিব্বতের মানস সরোবর সংলগ্ন একটি প্রস্রবণ থেকে। নদীটি লম্বায় প্রায় ৩ হাজার ১৮০ কিলোমিটার। এর তীরেই ২ হাজার ৫০০ খ্রিস্টপূর্বে গড়ে উঠেছিল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতা।
তিব্বতে উৎপত্তি হওয়ার পর জম্মু-কাশ্মীরের উপর দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে এই নদী। পঞ্জাব প্রদেশের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে শেষে দক্ষিণের বন্দর শহর করাচির কাছে আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে সিন্ধু নদী।
সিন্ধুর মূল উপনদী হল বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী ও বিপাশা। সিন্ধু জল চুক্তিতে এই নদীগুলির জলের ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও চুক্তিতে শতদ্রু নদীর জলের ব্যবহারের কথাও বলা রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, পূর্ব দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্য দিকে পশ্চিম দিকের সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। জলের নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভারত ও ৭০ শতাংশ পাবে পাকিস্তান।
পশ্চিম দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল নয়াদিল্লি যে একেবারেই ব্যবহার করতে পারবে না, এমনটা নয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে এই তিনটি নদীর জল স্থানীয় ভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ভারত। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ চলাচল ও মাছ চাষের জন্য ভারতের এই তিনটি নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ন’বছর আলোচনার চলার পর সিন্ধু জলচুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছিল। যার মধ্যস্থতাকারী বিশ্ব ব্যাঙ্ক একটি সালিশি আদালত তৈরি করেছে। যা চুক্তির শর্ত পুনর্মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই ভূমিকায় প্রথম থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে নয়াদিল্লি। সালিশি আদালত ভেঙে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে ভারত। যা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বিশ্ব ব্যাঙ্ক।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত পাক যুদ্ধের নেপথ্যে ছিল সিন্ধু নদীর জলের দখল। সেই কারণেই কাশ্মীর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বাধীন সরকার। দিল্লি এই চুক্তি ভেঙে দিলে জলের জন্য ফের পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের সেনাকে লড়াইয়ের ময়দানে মুখোমুখি দেখা যেতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।