ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরেই আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে চিন। একে একে ভারতের পড়শি দেশগুলিকে তারা হাত করে নিতে চায়। সেই কাজে ইতিমধ্যে অনেকাংশেই সফল হয়েছে বেজিং।
মলদ্বীপে চিনের ঘনিষ্ঠ শাসক ক্ষমতায় এসেছেন। শ্রীলঙ্কাকেও পর পর আর্থিক সাহায্য দিয়ে বশে রেখেছে বেজিং। এ ভাবে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ‘সশরীরে’ না থেকেও ভারতকে চাপে রাখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের দক্ষিণের মহাসাগরে শুরু হয়েছে এক নতুন ‘যুদ্ধ’। যাকে বলা হচ্ছে ‘কোবাল্ট ওয়ার’। ভারত মহাসাগরে কোবাল্ট ধাতুর যে খনি রয়েছে, তাকে কেন্দ্র করেই এই প্রতিযোগিতা চলছে।
ভারত মহাসাগরের ভিতরে নিমজ্জিত অবস্থায় আছে নিকিটিন সমুদ্র-পর্বত (সিমাউন্ট)। এই পর্বতেই রয়েছে কোবাল্টের খনি। যাকে ভারত মহাসাগরের গুপ্ত ‘যকের ধন’ বলছেন কেউ কেউ।
ভূতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ভারত মহাসাগরের নীচে এক সময় বিশাল একটি আগ্নেয়গিরি ছিল। তার অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নিকিটিন পর্বত তৈরি হয়েছে। সমুদ্রে নিমজ্জিত এই পাহাড়েই কোবাল্টের খনি রয়েছে। যা কয়েক লক্ষ কোটি টাকার সম্পদের উৎস।
সম্প্রতি সেখান থেকেই কোবাল্ট উত্তোলন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ভারত। নয়াদিল্লি থেকে গত জানুয়ারি মাসে সরকারি আধিকারিকেরা গিয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষের (ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটি) কাছে কোবাল্ট উত্তোলনের জন্য আবেদন জমা দিয়ে এসেছেন।
নিকিটিন পাহাড় ভারত মহাসাগরের যে অংশে রয়েছে, তা কোনও নির্দিষ্ট দেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে না। আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ ওই অংশের দায়িত্বে। তাই সেখানে কোনও কাজের জন্য তাঁদের অনুমতি নিতে হয়।
ভারতের সমুদ্রসীমা থেকে নিকিটিন পাহাড় খুব একটা দূরে নয়। তাই হিসাব মতো সেখান থেকে কোবাল্ট উত্তোলনের অনুমতি পেতে নয়াদিল্লির খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাধা এসেছে অন্য দিক থেকে।
সমুদ্রের নীচের পর্বত থেকে কোবাল্ট উত্তোলনের জন্য আবেদন জানিয়েছে শ্রীলঙ্কাও। ভারতের দক্ষিণের ছোট্ট এই পড়শি দেশ কিন্তু দূরত্বের দিক থেকে নিকিটিন পাহাড়ের বেশি কাছে অবস্থিত। ফলে সে দিক থেকে তাদের দাবি জোরালো।
কোবাল্ট তুলতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছিল মলদ্বীপও। কিন্তু সমুদ্র থেকে ধাতু উত্তোলনের মতো প্রযুক্তি তাদের হাতে না থাকায় সেই আবেদন গ্রাহ্য না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এখন প্রশ্ন, শ্রীলঙ্কার কি সমুদ্রে পুরোদমে খনির কাজ চালানোর মতো ক্ষমতা রয়েছে?
এখানেই অদৃশ্য হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে চিন। মনে করা হচ্ছে, কোবাল্ট উত্তোলনের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। সেই জোরেই উত্তোলনের আবেদন জানিয়েছে কলম্বো।
কোবাল্টের বাণিজ্যে এমনিতে এগিয়ে আফ্রিকার কঙ্গো প্রজাতন্ত্র। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোবাল্টের খনি রয়েছে তাদের সমুদ্রসীমায়। সেখান থেকে সারা বিশ্বের অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কোবাল্ট উত্তোলন করা হয়।
ভারত মহাসাগরের কোবাল্টের খনি থেকে নিয়মিত উত্তোলন শুরু হলে এই ব্যবসায় ভারতও এগিয়ে আসতে পারবে। সে ক্ষেত্রে কোবাল্টের বাণিজ্যে কঙ্গোর উপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমবে।
ভারত, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ— কেউ এখনও কোবাল্ট উত্তোলনের প্রয়োজনীয় অনুমতি পায়নি। আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষের দফতর রয়েছে জামাইকায়। সব দিক বিবেচনা করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কোনও একটি দেশকে অনুমতি দেওয়া হবে সেখান থেকে।
কোবাল্ট নিয়ে কেন এত কাড়াকাড়ি? কী বিশেষত্ব রয়েছে এই ধাতুর? বস্তুত সমুদ্র থেকে উত্তোলিত কোবাল্ট বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পে বিশেষ ভাবে কাজে লাগে। এই ধাতু দিয়ে ব্যাটারি তৈরি হয়।
ছোট পেনসিল ব্যাটারি থেকে শুরু করে মোবাইল, ঘড়ি কিংবা আরও বড় কোনও যন্ত্র, কোবাল্ট ছাড়া ব্যাটারি তৈরি করা যায় না। ব্যাটারি তৈরির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান লিথিয়াম। তার সঙ্গে কোবাল্টও প্রয়োজন হয়।
সভ্যতা যত আধুনিক হয়েছে, বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির ব্যবহার তত বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ব্যাটারি এই ধরনের যন্ত্রপাতির প্রাণ। ফলে কোবাল্ট খনিতে দখল পেলে ব্যাটারি শিল্প থেকে ভারত প্রভূত রোজগার করতে পারবে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত মহাসাগরের কোবাল্ট খনি পরোক্ষে দখল নিতে চাইছে চিন। শ্রীলঙ্কাকে সেই কাজে তারা ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। চিনের মদতেই নিকিটিন পাহাড়ের কোবাল্ট উত্তোলনের দিকে হাত বাড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা।
কিছু দিন আগেও ভারতের দক্ষিণের এই দ্বীপরাষ্ট্র চরম আর্থিক সঙ্কটে ভুগছিল। সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। সে দেশের প্রেসিডেন্ট দেশছাড়া হয়েছিলেন। সে সময়ে শ্রীলঙ্কাকে অর্থসাহায্য করে ভারতই।
তাই শ্রীলঙ্কা ভারতের চূড়ান্ত বিরোধিতা করবে বলে অনেকেই মনে করছেন না। একাধিক রিপোর্টে দাবি, কোবাল্ট তোলার ক্ষেত্রে ভারতের আবেদন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। কারণ ভারত এ ক্ষেত্রে নিকটবর্তী দেশগুলির তুলনায় সবচেয়ে বেশি যোগ্য।
কোবাল্ট উত্তোলনের অনুমতি আদৌ ভারত পায় কি না, পেলে চিনের মদতপুষ্ট শ্রীলঙ্কাকে টপকে কী ভাবে ওই এলাকায় কাজ চালায়, সমুদ্রের ক্ষেত্রে কোন নীতি নেয় নয়াদিল্লি, সে দিকে নজর থাকবে।