রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্যে সুইৎজ়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ‘শান্তি বৈঠক’ কতটা ফলপ্রসূ? সেই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। সব থেকে বড় প্রশ্ন ছিল, শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে কোন কোন দেশকে ইউক্রেন পাশে পাবে। শুধু তা-ই নয়, নজর ছিল ভারত, চিনের মতো দেশগুলির অবস্থানের দিকেও।
১৫ এবং ১৬ জুন, সুইৎজ়ারল্যান্ডে শান্তি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দু’দিন ব্যাপী এই বৈঠকে ছিলেন ভারতের প্রতিনিধি। তার পর থেকেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি রাশিয়ার থেকে ‘দূরত্ব’ রাখতে চাইছে ভারত? বৈঠক শেষে সেই প্রশ্নের উত্তর খানিকটা স্পষ্ট হল।
বৈঠকে যোগ দিলেও ভারত সই করল না যৌথ বিবৃতিতে। শুধু ভারত নয়, বৈঠকে যোগ দেওয়া কমপক্ষে সাতটি দেশ একই পথে হেঁটেছে। সেই তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো এবং সংযুক্ত আবর আমিরশাহি।
শান্তি বৈঠকে ব্রাজিল পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিয়েছিল। আর চিনের মতো দেশ এই বৈঠক থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে রাখল। কেন তারা বৈঠকে যোগ দিল না, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও বার্তা দেয়নি বেজিং।
সম্প্রতি জি৭ বৈঠকে যোগ দিতে বিশ্বের তাবড় নেতারা ইটালি গিয়েছিলেন। জি৭-এর সদস্য না হওয়ায় সেই বৈঠকে যোগ দেয়নি ভারত। কিন্তু আমন্ত্রণ পেয়ে ইটালি গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
জি৭ সম্মেলনের পর ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে সুইৎজ়ারল্যান্ডে বিশেষ বৈঠক বসেছিল। শনি এবং রবিবার সেই বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের প্রতিনিধি।
এই শান্তি আলোচনায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন মোদী। কিন্তু তিনি সেই বৈঠকে যোগ দেননি। এই বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন বিদেশ মন্ত্রকের সচিব (পশ্চিম) পবন কপূর।
আলোচনায় অংশ নিলেও বৈঠকের শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে সই করেননি তিনি। কেন সই করল না ভারত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাশিয়ার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ রক্ষা করতেই কি এই সিদ্ধান্ত? না কি অন্য কোনও কারণ?
কেন বিবৃতিতে সই করল না ভারত? সেই প্রশ্নে পবন বলেন, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি, দু’পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানই স্থায়ী শান্তি আনতে পারে। তাই আমরা যৌথ বিবৃতিতে সই করিনি।’’
তবে কূটনৈতিক মহলের একাংশ আবার বলছে অন্য কথা। ভারত কোনও ভাবেই রাশিয়ার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ নষ্ট করতে নারাজ। দেশের ৬০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জামের জন্য রাশিয়ার উপরে নির্ভরশীল ভারত।
রাশিয়া ‘বেঁকে’ বসলে বিপদে পড়তে পারে ভারত। শুধু সামরিক সরঞ্জাম নয়, তেল, সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও রাশিয়া থেকে আমদানি করে ভারত।
২০২২ সাল থেকেই ইউক্রেনের উপরে রাশিয়ার একতরফা আক্রমণের বিরোধিতায় মুখর হয়নি ভারত। বরং আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ একাধিক দেশের নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ভারতকে সে ভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে শোনা যায়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা করলেও কারও পক্ষে দাঁড়ায়নি নয়াদিল্লি। রাষ্ট্রপুঞ্জে দাঁড়িয়েও তেমন ভাবে সোচ্চার হয়নি তারা। তবে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল ভারতের তরফে।
শান্তি বৈঠকে আমন্ত্রণ পায়নি রাশিয়া। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন, যুদ্ধবিরতিতে যেতে তিনি রাজি। কিন্তু তার জন্য ইউক্রেনকে মানতে হবে কিছু শর্ত!
শর্ত হিসাবে রাশিয়া প্রথমেই জানায়, ইউক্রেন যদি নেটোতে যোগদানের পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকে, তবেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করে আলোচনায় বসা সম্ভব। একই সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট আরও দাবি করেছেন, রাশিয়া চারটি অধিকৃত অঞ্চল থেকে সেনা সরাতে হবে ইউক্রেনকে।
রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনের সঙ্গেও সদ্ভাব বজায় রেখেছে ভারত। এ বার ইটালিতে গিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে পার্শ্ববৈঠক করেছেন মোদী।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত বছর জাপানে জি৭ বৈঠকে গিয়েও জ়েলেনস্কির সঙ্গে পার্শ্ববৈঠক করেছিলেন মোদী। বলেছিলেন, “আমি মনে করি না, এটি (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ) কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়। আমার কাছে এটি মানবিকতার বিষয়। মানবিক মূল্যবোধের ব্যাপার।”
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে পুতিনবাহিনীর হামলা শুরু ইস্তক রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে মস্কোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি নয়াদিল্লি। যদিও একাধিক বার প্রকাশ্যে যুদ্ধ বন্ধের জন্য সওয়াল করেছেন মোদী।
তার পরও কেন যৌথ বিবৃতিতে সই করে ‘শান্তি’র পক্ষে থাকল না ভারত? ভারত ছাড়াও শান্তি বৈঠকে যোগ দেওয়া এবং বিবৃতিতে সই না করা নিয়ে বিশ্ব বিভাজিত। অনেকেই মনে করছেন, এই বৈঠক নিয়ে দেশগুলি যা অবস্থান নিয়েছে তাতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পাল্টে যেতে পারে পূর্ব বনাম পশ্চিম বিশ্বের ‘লড়াইয়ে’!
কূটনৈতিক মহলের অনেকের মতে, পরিস্থিতি এখনও খুব খারাপ হয়নি। তবে শান্তি সম্মেলন হয়তো ‘লড়াইয়ের’ বীজ পুঁতে দিল।