ভোরবেলা ঘুম ভাঙানোর নিত্যদিনের সঙ্গী অ্যালার্মের সুর। মোবাইল ফোনের আগে ঘুম ভাঙানোর ভরসা ছিল অ্যালার্ম ঘড়ি। কিন্তু অ্যালার্ম ঘড়ি আবিষ্কারের আগে এক অভিনব পন্থায় ঘুম ভাঙানো হত ব্রিটেনের শ্রমিকদের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভোরবেলায় শ্রমিকদের ঘুম ভাঙাতে রাস্তায় দেখা যেত ঘুমভাঙানিয়াদের। কারও হাতে থাকত লম্বা পাইপ, তো কারও হাতে হাতুড়ি। বিশেষ নামও রাখা হয়েছিল তাঁদের— ‘নকার আপার’।
সাধারণত প্রবীণেরাই ‘নকার আপার’-এর পেশায় যোগ দিতেন। বয়স বেড়ে চলেছে অথচ সংসারের জন্য রোজগারও প্রয়োজন— এই ধরনের প্রবীণেরাই ভোরবেলা ঘুম ভাঙানোর জন্য রাস্তায় বার হতেন।
সাধারণত ব্রিটেনের উত্তরাংশে মিল টাউন এলাকায় ‘নকার আপার’-এর প্রচলন বেশি ছিল। সেখানকার যে শ্রমিকেরা ভোরের শিফ্টে কাজ করতেন তাঁরা এই ‘নকার আপার’দের বেতন দিয়ে কাজে রাখতেন।
‘নকার আপার’রা ভোরবেলায় শ্রমিকদের ঘুম ভাঙানোর জন্য তাঁদের বাড়ির সামনে যেতেন। তার পর ঘণ্টা বাজিয়ে বা জোরে শব্দ করে ঘুম ভাঙাতেন শ্রমিকদের। কিন্তু কিছু দিন পর শ্রমিকদের অধিকাংশ এই বিষয়ে আপত্তি জানাতে শুরু করেন।
শ্রমিকদের দাবি, ‘নকার আপার’দের বেতন তাঁরা একাই দিচ্ছেন, কিন্তু জোর শব্দের ফলে প্রতিবেশীদেরও ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতিবেশীদের একাংশ অভিযোগ জানাতেন।
‘নকার আপার’দের কাছে অভিযোগ জানাতেন শ্রমিকেরাও। তাঁদের দাবি, ‘নকার আপার’দের তাঁরা আলাদা ভাবে বেতন দিতেন শুধুমাত্র তাঁদের ঘুম ভাঙানোর জন্য।
কিন্তু জোর শব্দের কারণে এমন কয়েক জন শ্রমিকেরও ঘুম ভেঙে যেত যাঁরা ‘নকার আপার’দের কোনও পারিশ্রমিক দিতেন না।
পরবর্তী কালে ঘুম ভাঙানোর জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করেন ‘নকার আপার’রা। তাঁদের হাতে এক ধরনের লম্বা লাঠি থাকত যা দিয়ে শ্রমিকদের শোয়ার ঘরের জানলায় টোকা দিতেন।
বাঁশের লাঠি তৈরি করে শ্রমিকদের বাড়ির দরজাতেও ধাক্কা দিতেন ‘নকার আপার’রা। সপ্তাহ শেষে বেতন পেতেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে থাকত ‘স্নাফার আউটার’ নামে একটি যন্ত্র। এই যন্ত্রের মাধ্যমে সন্ধ্যায় যে গ্যাসবাতিগুলি জ্বালানো হত সেগুলি নিভিয়ে দেওয়া হত।
যত ক্ষণ শ্রমিকদের ঘুম ভাঙত না তত ক্ষণ পর্যন্ত জানলায় লাঠি দিয়ে টোকা মেরে যেতেন ‘নকার আপার’রা। সেই শ্রমিকের ঘুম ভেঙে গেলে পরবর্তী শ্রমিকের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করতেন তাঁরা।
লম্বা লাঠি ছাড়াও মটরের দানা ছুড়েও শ্রমিকদের ঘুম ভাঙাতেন ‘নকার আপার’রা। সরু ফাঁপা লাঠির ভিতর মটরের দানা ভরে শ্রমিকদের শোয়ার ঘরের জানলায় ছুড়ে মারতেন তাঁরা।
শ্রমিকদের ঘুম ভাঙানোর জন্য প্রায় সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাতেন ‘নকার আপার’রা। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন তাঁরা।
ঘুম ভাঙানোর কাজ শেষ হয়ে গেলে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতেন ‘নকার আপার’রা। বাড়ি ফিরে বিকেল অথবা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিতেন তাঁরা।
সন্ধ্যার পর আর ঘুমোতেন না ‘নকার আপার’রা। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম না ভাঙলে শ্রমিকদেরও ঘুম ভাঙাতে পারবেন না। সেই ভয়ে রাতে জেগে বসে থাকতেন তাঁরা। অনেকে তাঁদের ‘প্যাঁচা’ বলেও সম্বোধন করতেন।
১৯৭০ সালের গোড়ার দিকেও ‘নকার আপার’দের দেখা যেত। মূলত ব্রিটেনের যে এলাকাগুলিতে শ্রমিকেরা থাকতেন সেখানেই ‘নকার আপার’দের দেখা মিলত।
শুধুমাত্র ব্রিটেনেই নয়, নেদারল্যান্ডস এবং আয়ারল্যান্ডেও দেখা মিলত ঘুমভাঙানিয়াদের। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে এঁদের ব্যবহার কমতে শুরু করে। তবুও ইংল্যান্ডের কিছু কিছু জায়গায় ১৯৭০ সালের গোড়া পর্যন্ত এঁদের দেখা মিলত।
প্রবীণেরা ছাড়াও ‘নকার আপার’ হিসাবে কাজ করতেন অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা। অনেক সময় পুলিশকর্মীদেরও ঘুম ভাঙাতে দেখা যেত। রাতে কাজ করে ফেরার পর অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য এই পেশা বেছে নিতেন পুলিশকর্মীরা।