হাথরস জুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। মঙ্গলবার বিকেলে হাথরসের সিকান্দরারাউ এলাকায় ‘সৎসঙ্গ’ অনুষ্ঠানে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ১২১।
সিকান্দরারাউ এলাকার স্থানীয় হাসপাতালগুলির বাইরে এখন শুধুই কান্নার রোল। স্বজন হারানোর কান্না। কেউ কেউ আবার হাসপাতালের চারপাশ ছুটে বেড়াচ্ছেন পরিজনের খোঁজে। আদৌ বেঁচে আছেন কি না জানেন না তাঁরা।
কিন্তু কেন এই বিপর্যয়? কেন এই হাহাকার? এই নিয়ে অনেক দাবি, পাল্টা দাবি প্রকাশ্যে আসছে। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় সৎসঙ্গের আয়োজক কমিটিকেই দায়ী করছেন অনেকে। অনেকে প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন। অনেকের আবার দাবি, ভক্তদের হুড়োহুড়ির কারণেই এই দুর্ঘটনা।
যদিও এই ঘটনায় অনেকে স্বঘোষিত গুরু নারায়ণ সাকার হরি ওরফে ‘ভোলে বাবা’র দিকে আঙুল তুলেছেন, যাঁর আশ্রমে ওই সৎসঙ্গের আয়োজন করা হয়েছিল।
সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, ভোলে বাবার ‘চরণধূলি’ পাওয়ার তাগিদেই বিপত্তি বাধে সৎসঙ্গস্থলে।
ভোলে বাবাকে প্রণাম করার জন্য হাজার হাজার লোকের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তখনই পদপিষ্ট হয়ে মারা যান অনেকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সৎসঙ্গের আয়োজন করা হয়েছিল একটি খোলা মাঠে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা এবং রাজস্থান থেকে বহু ভক্ত এসেছিলেন সেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি যখন শেষ হওয়ার মুখে, তখনই ভক্তেরা ভোলে বাবার আশীর্বাদ এবং তাঁর পদধূলি পেতে ভিড় করে এগিয়ে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেই সময়ই বিপত্তি ঘটে। পদধূলি পাওয়ার হুড়োহুড়িতে এবড়োখেবড়ো মাটিতে হোঁচট খেতে শুরু করেন ভক্তেরা। অনেকে পড়ে যান। বাকিরা তাঁদের পদদলিত করে চলে যান।
এই দাবির মধ্যে যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। হাথরসের ওই সৎসঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমেছিল। কেউ বলছেন সেই সংখ্যা ১০ হাজার, কেউ বলছেন ৫০ হাজার। আবার কারও কারও মতে সৎসঙ্গদের অনুগামীদের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছিল। অর্থাৎ, সেই ভিড়ের কিছু অংশও যদি ভোলে বাবাকে প্রণাম করতে উদ্যত হন, তা হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
আবার প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, সৎসঙ্গের জন্য যে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছিল, তা ঘেরা ছিল। পাখার ব্যবস্থা করা হয়নি। প্যান্ডেল খোলামেলা থাকলেও আর্দ্রতা এবং গরমের কারণে সকলেই হাঁসফাঁস করছিলেন।
ফলে সৎসঙ্গ শেষ হওয়ার পরেই মানুষ হুড়মুড়িয়ে মাঠের বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আসা-যাওয়ার জন্য যে গেট তৈরি হয়েছিল, সেটিও অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হওয়ার কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অনেকে মাটিতে পড়ে যান। বাকিরা তাঁদের উপর দিয়েই বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করেন।
অনেকে আবার দাবি করেছেন, হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম হলেও প্যান্ডেলের মধ্যে কিছু হয়নি। রাস্তায় যে গেট তৈরি হয়েছিল, সেখান দিয়ে বেরোনোর সময় অনেকে রাস্তার ডান দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন, আর অনেকে বাঁ দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সময়ই ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। যাঁরা মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের উপর দিয়েই অনেকে চলে যান।
তবে যাঁকে নিয়ে এত হইচই এবং যাঁর ‘চরণধূলি’ পাওয়ার জন্য বিপত্তি বলে দাবি, সেই ভোলে বাবা কোথায়? স্বঘোষিত ধর্মগুরুর সন্ধান এখনও মেলেনি বলেই জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে খবর, ফুলরাই গ্রাম থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে মৈনপুরি এলাকায় আশ্রম রয়েছে ভোলে বাবার। পদপিষ্টের ঘটনার পর সেই আশ্রমেই গিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যেরা। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভোলে বাবার খোঁজ মেলেনি।
স্বঘোষিত এই ধর্মগুরু উত্তরপ্রদেশেরই বাসিন্দা। উত্তরপ্রদেশের এটাহ্ জেলার পাতিয়ালি পঞ্চায়েতের বাহাদুর নাগরি গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে তাঁর জন্ম।
ভোলে বাবার আসল নাম সুরজ পাল সিংহ। পড়াশোনা শেষ করে উত্তরপ্রদেশ পুলিশে যোগ দেন সুরজ। প্রায় ১৮ বছর উত্তরপ্রদেশে পুলিশের ‘ইনটেলিজেন্স ইউনিটের’ হেড কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন তিনি।
ভোলে বাবার অনুগামীদের দাবি, অতীতে গোয়েন্দা বিভাগের হয়েও তিনি কাজ করেছেন। কিন্তু ধর্মীয় বাণী প্রচারের জন্য ১৯৯৯ সালে তিনি নাকি গোয়েন্দা বিভাগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
চাকরি ছেড়ে নিজের নাম পরিবর্তন করে নারায়ণ সাকার হরি রাখেন সুরজ। সুরজ পাল হয়ে ওঠেন ভোলে বাবা। এর পরে পরেই শুরু সৎসঙ্গের।
এখন হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, দিল্লি-সহ গোটা ভারতে অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে রয়েছে স্বঘোষিত এই ধর্মগুরুর।
ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে ভোলে বাবার কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। তাঁর ভক্তদের দাবি, সমাজে বিভিন্ন স্তরে তাঁর অনুপ্রেরণা কাজ করে।
ইউটিউবে ভোলে বাবার নামে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে সেটি তিনিই পরিচালনা করেন কি না তা স্পষ্ট নয়।
ওই ইউটিউব চ্যানেলটিতে ভক্তিমূলক গান এবং ভোলে বাবার বিভিন্ন সৎসঙ্গের প্রচার চালানো হয়।
উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে প্রতি মঙ্গলবার ভোলে বাবার নামে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে জড়ো হন হাজার হাজার ভক্ত।
সেই অনুষ্ঠানের সময় ভক্তদের খাবার এবং পানীয় জলের ব্যবস্থাও করা হয়। দায়িত্বে থাকেন স্বেচ্ছাসেবীরা।
ভক্তদের মতে, স্বঘোষিত গুরু তাঁর গ্রামের একটি কুঁড়েঘরে থাকেন। যদিও প্রচারের জন্য সারা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ভ্রমণ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, স্বঘোষিত গুরুদের সাজপোশাক সচারচর যেমন হয়, ভোলে বাবার তেমনটা নয়।
বেশির ভাগ সময়ই ভোলে বাবাকে সাদা ব্লেজ়ার-প্যান্ট-টাই বা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে থাকতে দেখা যায়। হাতে ঘড়ি, আঙুলে আংটি থাকে। যেখানেই সৎসঙ্গ করতে যান, পাশে থাকেন স্ত্রী প্রেমবতী।
ভোলে বাবার নিজস্ব একটি নিরাপত্তাবাহিনী রয়েছে। নাম ‘নারায়ণী সেনা’। সেই দলে পুরুষ এবং মহিলা— উভয়ই রয়েছেন। তাঁর সৎসঙ্গে হওয়া বিশাল জনসমাগমের জন্য ‘নারায়ণী সেনা’ই আশ্রম থেকে সৎসঙ্গস্থলে নিয়ে যান ভোলে বাবাকে।
তবে এর আগেও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভোলে বাবা। অতিমারির সময় জমায়েতে যখন নিষেধাজ্ঞা ছিল, তখনও ভোলে বাবার অনুষ্ঠানে জড়ো হতেন শয়ে শয়ে মানুষ। ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের ফারুখাবাদে একই রকম একটি সৎসঙ্গের আয়োজন করেছিলেন স্বঘোষিত গুরু।
জেলা প্রশাসন শুধুমাত্র ৫০ জনকে সেই সৎসঙ্গে যোগদানের অনুমতি দিলেও জড়ো হয়েছিলেন ৫০ হাজার মানুষ। বিশাল জনসমাগমের জন্য এলাকাতে যানজটেরও সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ভোলে বাবার নাম এ বার জড়াল হাথরসকাণ্ডেও।