কিছু দিন আগেই ইরান সফরে গিয়েছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ইরানের সড়ক ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী মেহেরদাদ বাজরপাশের সঙ্গে একটি বন্দর নিয়ে কথা হয় তাঁর।
ইরানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ওই বন্দরটির নাম চাবাহার। ভারত-ইরান সম্পর্কের বন্ধনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিতে পারে এই বন্দর। সূত্রের খবর, ইরানীয়দের সঙ্গে চাবাহার নিয়ে ইতিবাচক বৈঠকই হয়েছে জয়শঙ্করের।
ওমান উপসাগরের একেবারে মুখে রয়েছে চাবাহার। এটি ইরানের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
ইরান-পাকিস্তান সীমান্তের পশ্চিম দিকে রয়েছে চাবাহার বন্দর। আর তা থেকে কিছুটা দূরেই পাকিস্তানের মাটিতে রয়েছে গদর বন্দর, যা চিন তৈরি করে দিয়েছে। এই বন্দর ইরান-পাকিস্তান সীমান্তের ঠিক পূর্বে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চাবাহার এবং গদর বন্দর দু’টি পরস্পর প্রতিস্পর্ধী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দু’টিই গভীর সমুদ্রবন্দর। এই বন্দর ইরান এবং পাকিস্তানের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতাকে ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে অনেকের মত।
ইরানের জন্য চাবাহার বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার বাধার সম্মুখীন হলেও এই বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন চালিয়ে যেতে পারে তেহরান।
ইরান তো বটেই, ভারতের জন্যও কিন্তু ইরানের চাবাহার বন্দর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এই বন্দর ব্যবহার করতে পারলে ভারতের অনেক সুবিধা হবে।
আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার মাটিতে ভারতের বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক পাকিস্তান। তাদের ভূখণ্ড ভারত ব্যবহার করতে পারে না।
ফলে পাকিস্তানকে টপকে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলির কাছে পৌঁছতে হলে ভারতকে অনেক পথ ঘুরতে হয়। ইরান এখানেই ভারতের 'বন্ধু' হয়ে উঠতে পারে।
অবিভক্ত ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ছিল ইরান। দেশভাগের পর পাকিস্তান তৈরি হওয়ায় ইরান তথা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ ছিন্ন হয়। তবে সে সময় ভারতের সদ্য অঙ্কুরিত অর্থনীতিতে তার তেমন প্রভাব পড়েনি।
নব্বইয়ের দশকে ভারতের বাণিজ্য আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও বেশি করে ডালপালা মেলতে শুরু করেছিল। সেই সময় ইরানের সঙ্গেও দিল্লির যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ইরান-ভারত সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছিল। কারণ, দুই দেশই পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সুন্নি ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন এবং তাদের কার্যকলাপের বিরোধী ছিল।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে চিন পাকিস্তানে গদর বন্দর নির্মাণ শুরু করে। ভারতের কাছে ইরানের সহায়তা এবং চাবাহার আরও বেশি জরুরি হয়ে ওঠে ওই সময় থেকেই।
বস্তুত, ইরানের চাবাহার বন্দর তৈরিতে সাহায্য করেছিল ভারতও। ২০১৬ সালে ইরান, ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে এই বন্দর নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তার পর থেকে বন্দরটির উন্নয়নে অবদান রাখছিল ভারতের জাহাজ মন্ত্রক।
পরে চাবাহার দিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে অল্পবিস্তর বাণিজ্যও করেছে ভারত। আফগানিস্তান থেকেও পণ্য ভারতে ঢুকেছে ওই বন্দর দিয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের এই বন্দর ব্যবহার কমেছে।
আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা ভাল চোখে দেখেনি ইরান। ফলে চাবাহার বন্দরকে কেন্দ্র করে ভারতের একাধিক প্রকল্পে ইরান সম্মতি দিতে দেরি করে বলে অভিযোগ।
ইরানের উপর পশ্চিমি দুনিয়ার একাধিক বিধিনিষেধ ভারতের পক্ষে চাবাহার ব্যবহার আরও কঠিন করে তোলে। আফগানিস্তানে তালিবান সরকার গঠনের পর আরও এক বার ধাক্কা খায় ভারত-ইরান সম্পর্ক।
ইরানের সঙ্গে আবার সম্পর্কের উন্নতি করার চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি। ২০২৩ সালে তারা জানিয়েছে, চাবাহার বন্দরের উন্নয়নের খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে ভারতের তরফে। ওই বন্দর দিয়ে ২০ হাজার মেট্রিক টন গম আফগানিস্তানে পাঠানোর কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।
এর মাঝেই পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। যা ভারতের জন্য ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে। চাবাহার বন্দরকে কাজে লাগিয়ে এশিয়ার বাণিজ্যে চিনা মদতপুষ্ট পাকিস্তানকে অনায়াসে টক্কর দিতে পারে ভারত।