ভারতের পরমাণু শক্তি গবেষণার জনক হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। তাঁর হাত ধরেই পরমাণু গবেষণার জগতে প্রবেশ করে ভারত।
ভারতকে অবশ্য সেই সময় পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকা, চিন, রাশিয়ার সমকক্ষ করে তুলতে পারেননি ভাবা। তার আগেই দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর।
কিন্তু ভাবার মৃত্যু নিয়ে দানা বেঁধেছিল নানা বিতর্ক। অনেকে মনে করেন, নিছক বিমান দুর্ঘটনা নয়, তাঁর মৃত্যুর নেপথ্যে ছিল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে তিনি ভারতকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই প্রয়াস নাকি তৎকালীন ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলির চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।
১৯৬৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে একটি সাক্ষাৎকার দেন ভাবা। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি যদি সুযোগ পাই, ১৮ মাসের মধ্যে আমি ভারতের জন্য পরমাণু বোমা বানিয়ে দেখাতে পারি।’’
এই সাক্ষাৎকারের ঠিক ৩ মাস পর ভাবার মৃত্যু হয়। তিনি যে বিমানে ছিলেন, সেটি ভেঙে পড়ে আল্পস পর্বতের এক দুর্গম অঞ্চলে। মৃত্যু হয় বিমানের মোট ১১৭ জন যাত্রীর।
১৯০৯ সালে মুম্বইয়ের সম্ভ্রান্ত এক পার্সি পরিবারে জন্ম হয় ভাবার। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। তার পর কাজ শুরু করেন পরমাণু পদার্থবিদ্যা নিয়ে। ১৯৪৮ সালে তাঁকে শীর্ষে রেখেই শুরু হয় ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের পথচলা।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সখ্য ছিল ভাবার। নেহরু তাঁকে দেশের পরমাণু গবেষণা বিষয়ক কর্মসূচির ডিরেক্টর হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন।
১৯৬১ সালে চিনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে ভারতকে গড়ে তুলতে উঠে পড়ে লাগেন ভাবা। ১৯৬৩ সালে রাজস্থানে ভারতের প্রথম পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তে বলা হয়েছিল, যুদ্ধ বা কোনও রকম সামরিক ক্রিয়াকলাপে এই শক্তি কাজে লাগাতে পারবে না ভারত।
পরমাণু গবেষণার পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন ভাবা। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুতে থমকে যায় ভারতের অগ্রগতি। ঠিক কী হয়েছিল দুর্ঘটনার দিন? কেন এত বিতর্ক ভাবার মৃত্যু নিয়ে?
১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি সকাল ৮টা ২ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ মুম্বই থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেয়। বিমানটিতে ১১ জন বিমানকর্মীর সঙ্গে ছিলেন ১০৬ জন যাত্রী। দিল্লি, বেরুট (লেবানন) এবং জেনেভা হয়ে লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল বিমানটির।
বেরুট থেকে লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি দেওয়ার পর ইটালি এবং ফ্রান্স সীমান্তে আল্পস পর্তবতমালা তথা পশ্চিম ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মঁ ব্লাঁ-র কাছে ধাক্কা খায় এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি। শীতকালে পুরো এলাকাই বরফে ঢাকা পড়ে ছিল।
দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে উদ্ধারকার্যের জন্য পৌঁছয় ফরাসি বাহিনী। কিন্তু যত ক্ষণে তাঁরা সেখানে পৌঁছেছিলেন, দেখা যায়, বিমানের ধ্বংসাবশেষ ডুবে গিয়েছে বরফের মাঝে। বিমানের ব্ল্যাকবক্স কিংবা অন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কিছুই পাওয়া যায়নি।
একে দুর্গম এলাকা, তার উপর আবহাওয়াও অনুকূল ছিল না। উদ্ধারকাজ থামিয়ে দেয় ফরাসি সরকার। কী ভাবে আল্পসের বুকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল, সেই তদন্ত শুরু হয়েছিল। কিন্তু তেমন কোনও তথ্য পাননি তদন্তকারীরা।
ফরাসি সরকারের তরফে এই বিমান দুর্ঘটনার যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, তাতে বলা হয়েছিল, যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে দুর্ঘটনা হয়। যে যন্ত্রের মাধ্যমে বিমান থেকে মাটির উচ্চতা নির্ণয় করা হয়, তাতে ত্রুটি ছিল। বিমান থেকে চালক কন্ট্রোল রুমে জানিয়েছিলেন, মাটি থেকে তাঁদের উচ্চতা ১৯ হাজার ফুট। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থেকে সে উচ্চতা ৩ হাজার ফুট বেশি। চালকের কথা শুনে বিমান নামাতে বলা হয় কন্ট্রোল রুম থেকে। তার পরেই ঘটে বিপত্তি।
তদন্তকারী আধিকারিকেরা জানিয়েছিলেন, চালকের ভুলেই ঘনিয়েছে বিপদ। চালক মনে করেছিলেন বিমান মঁ ব্লাঁ পাহাড় পেরিয়ে গিয়েছে। এই তত্ত্বেই সিলমোহর দেয় ফরাসি সরকার। ভারত সরকারও তা মেনে নেয়।
যদিও ফ্রান্সের সেই সময়কার জাতীয় সংবাদমাধ্যম ওআরটিএফের সম্পাদক ফিলিপ রেয়াল এই তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছিলেন। তিনি ক্যামেরা-সহ কিছু সাংবাদিককে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা দু'টি বিরুদ্ধ প্রমাণ খুঁজে পান।
সাংবাদিকেরা জানান, তাঁরা মঁ ব্লাঁ-য় গিয়ে একটি বিমানের ভাঙা অংশ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল জুন, ১৯৬০। অথচ এয়ার ইন্ডিয়ার যে বিমানটি ভেঙে পড়ে, তা তৈরি হয়েছিল ১৯৬১ সালে। এ ছাড়া, বিমানের সামনের দিকের আর একটি ভাঙা অংশও পাওয়া গিয়েছিল। দাবি, সেটিও দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের অংশ নয়।
সংবাদমাধ্যমের কার্যকলাপে এর পর সরকারি হস্তক্ষেপ করা হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু ওই সাংবাদিক দলের এক সদস্য দুর্ঘটনার নেপথ্যে অন্য তত্ত্ব তুলে ধরেন। তিনি জানান, ভাবার বিমানটি পাহাড়ে নয়, ধাক্কা খেয়েছিল অন্য একটি বিমানে।
২০০৮ সালে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র এক এজেন্টের প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব জোরদার হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, ভারতের পরমাণু শক্তি চর্চায় আমেরিকা খুব একটা খুশি হতে পারেনি। ১৯৪৫ সাল থেকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে একারই রাজত্ব ছিল আমেরিকার। ১৯৬৪ সালে এই শক্তির অধিকারী হয় চিন এবং রাশিয়াও। তার পর ১৯৬৫ সালে ভাবা সাক্ষাৎকারে জানান, তিনিও পরমাণু বোমা তৈরি করতে সক্ষম।
সিআইএ এজেন্ট সাক্ষাৎকারে এ-ও জানিয়েছিলেন, ভাবা তাঁদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু তার আগেই তাঁর বিমানে রাখা বোমাটি ফেটে গিয়েছে।
২০১৭ সালে মঁ ব্লাঁ অঞ্চলে তল্লাশি চালান ড্যানিয়েল রাউশ নামে এক ফরাসি ব্যবসায়ী। বিমান দুর্ঘটনা বিষয়ে ব্যক্তিগত তদন্ত করা তাঁর শখ। রাউশ জানান, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে তিনি একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান, যার ককপিটে একটি পিস্তল, ক্যামেরা ও বেশ কিছু কাগজপত্র পাওয়া যায়। তবে রাউশের মতে, ভাবার বিমান দুর্ঘটনার পিছনে অন্য বিমানের সঙ্গে ধাক্কা লাগার বিষয়টি সত্য।
আজও হোমি ভাবার মৃত্যু রহস্যাবৃত। ১৯৬৬ সালেরই ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রয়াত হন। লাল বাহাদুরের মৃত্যুও রহস্যাবৃত বলে দাবি অনেকেরই। এর পক্ষ কালের মধ্যেই হোমি ভাবার মৃত্যুকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন বহু মানুষ। লাল বাহাদুর বা হোমি ভাবা— কারও মৃত্যুরহস্যের কিনারাই আজ পর্যন্ত হয়নি বলে দাবি তাঁদের। আজও এই দুই মানুষের মৃত্যুকে ঘিরে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা খাড়া করে চলেছেন একের পর এক সম্ভাব্য যুক্তি।