মন্ত্রীকন্যা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, সেই স্কুলেই যোগ দিতে পারেন ববিতা সরকার। মেখলিগঞ্জের ইন্দিরা বালিকা বিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা ছিলেন অঙ্কিতা অধিকারী। সেই স্কুলে তাঁর পদে চাকরি পেতে পারেন ববিতা। হাই কোর্টের রায়ে বলা বয়েছে, অঙ্কিতার জায়গায় চাকরি দিতে হবে ববিতাকে। রায়ে স্কুলের নাম উল্লেখ করা না থাকলেও ববিতাকে যে ইন্দিরা বালিকা বিদ্যালয়েই নিয়োগ করা পারে, তা ধরে নেওয়া যায়।
ঘনিষ্ঠ মহলে ববিতা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যেহেতু ওই স্কুলটি মন্ত্রীর বাড়ির খুবই কাছে এবং পরেশ যেহেতু ওই এলাকার দীর্ঘ দিনের দাপুটে রাজনীতিবিদ, তাই ওই স্কুলে যোগ দিতে সামান্য ভয়ে আছেন তিনি। যদিও প্রকাশ্যে এ নিয়ে তিনি কিছু বলতে চাইছেন না।
ববিতার লড়াইকে অবশ্য কুর্নিশ করছেন সব পক্ষ। আদালত নির্দেশ দিয়েছে, মন্ত্রীকন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি দিতে হবে ববিতা সরকারকে। এমনকি, মন্ত্রীকন্যার বেতনের প্রথম কিস্তি— সাত লক্ষ ৯৬ হাজার ৪৪২ টাকা এবং ১০ দিনের সুদও তুলে দিতে হবে ববিতার হাতে। ঘোষণার পরই মুখে হাসি, চোখে জল ববিতার। আদালত চত্বরেই কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন স্বামীকে। কারণ মন্ত্রী এবং মন্ত্রীকন্যার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যে শুধু স্বামীকেই পাশে পেয়েছেন তিনি।
শুক্রবার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় শুনানির চলাকালীন জানতে চান, ‘‘ববিতা সরকারকে কি চাকরি দেওয়া হয়েছে? এখনও কেন তাঁকে নিয়োগ করা হল না?’’ জবাবে এসএসসি-র আইনজীবী জানান, আদালতের নির্দেশ মতো বেআইনি নিয়োগের অভিযোগে অনেককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ববিতাকে এখনও চাকরি দেওয়া যায়নি। এর পর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে। তখন তাঁকে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, মামলাকারী ববিতার নম্বর বেশি থাকা সত্ত্বেও ‘লজ্জাজনক ভাবে’ অঙ্কিতাকে ওই তালিকায় এক নম্বরে এনে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। অঙ্কিতাকে চাকরি দেওয়া না হলে ববিতা পেতেন। কারণ, তাঁর নাম ওয়েটিং লিস্টে ২০ নম্বরে ছিল। অঙ্কিতা এক নম্বরে আসায় ববিতার নাম যায় ২১ নম্বরে। সেই কারণেই ববিতাকে ১০ দিনের মধ্যে চাকরি দেওয়ার নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্ট।
শুধু তা-ই নয়, মন্ত্রীকন্যার চাকরিতে যোগ দেওয়ার দিনকেই ববিতার চাকরি পাওয়ার দিন হিসাবে ধরে নিতে হবে। ওই দিন থেকেই প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পাবেন ববিতা। শুক্রবার এমনই নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। পাশাপাশি শুক্রবার অঙ্কিতার ফেরত দেওয়া কিস্তির টাকাও ববিতাকে দেওয়ারও নির্দেশ আদালতের।
এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেন ববিতা। এত টাকা পেয়ে কী করবেন? এই জবাব দিতে গিয়েই তাঁর চোখ ভিজে যায় জলে। জানান, এই টাকা শুধু তাঁর নিজের জন্য নয়। টাকাটি তিনি কোনও ভাল কাজে ব্যবহার করবেন।
চাকরি পাবেন আশা থাকলেও অঙ্কিতার ভোগ করা টাকাও যে তাঁর কপালে আসবে তা স্বপ্নেও আশা করেননি ববিতা। বলেছেন, নিজের জন্য নয়, কোনও ভাল কাজে টাকা ব্যবহার করতে চান তিনি।
ববিতার দাবি, যদি নিয়ম মেনে নিয়োগ হত, তা হলে এত দিনে শিক্ষিকা হিসেবে তিনি চার বছর পার করতেন। কিন্তু মেধাতালিকায় ঠাঁই হওয়ার পরও ববিতা চাকরি করার সুযোগ পাননি। সেই জায়গায় প্রায় চার বছর ধরে রমরমিয়ে চাকরি করেন পরেশ-কন্যা অঙ্কিতা। এর প্রতিবাদেই লড়াই শুরু। এর পর দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর শুক্রবার জয় এসেছে তাঁর হাতে।
শুক্রবার কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশের পর আদালত থেকে বেরিয়ে হাসিমুখেই হাত তুলে জয়ের প্রতীক দেখান ববিতা। শিলিগুড়ির এই লড়াকু মেয়ের কথা এখন বাংলার ঘরে ঘরে।
শনিবার যোগাযোগ করা হলে ববিতা বলেন, ‘‘স্কুলে যোগ দেওয়ার নিয়োগপত্র এখনও পাইনি। তবে যা বলার তা তো আদালতের রায়েই লেখা আছে।’’
কেমন ছিল ববিতার দীর্ঘ আইনি লড়াই? কোন পথে হেঁটেই বা সুবিচার পেলেন তিনি?
এসএসসি মামলায় নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সিবিআইয়ের তলব পেয়ে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ তাঁর মেয়েকে নিয়ে এক প্রকার ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যান! আর এই মন্ত্রী উধাও করা ‘জাদু’র নেপথ্যে ছিলেন ববিতা।
ববিতার বাড়ি শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ে। এসএসসি-র যে মেধাতালিকার শীর্ষে মন্ত্রীকন্যার নাম উঠেছিল, বেশি নম্বর পেয়েও সেই তালিকা থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন ববিতা।
মন্ত্রীকন্যার চেয়ে ১৬ নম্বর বেশি পেয়েছিলেন। তবু ববিতার নাম তালিকার ২১ নম্বরে ছিল। আর পরেশের মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম ছিল মেধাতালিকার শীর্ষে।
ববিতা ২০১৬ সালে স্কুলশিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় বসেন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর মেধাতালিকা প্রকাশ হয়েছিল। সেই তালিকায় অবশ্য ববিতার নাম প্রথম ২০তেই ছিল। কিন্তু সেই তালিকা বাতিল করে দেয় এসএসসি।
কিছু দিন পর প্রকাশিত হয় নতুন তালিকা। নতুন তালিকায় ববিতার নাম ছিল ওয়েটিং লিস্টে। আর পুরনো তালিকায় কোথাও না থাকা অঙ্কিতার নাম নতুন সংযোজন!
তালিকায় হঠাৎ এক ধাপ নীচে নামলেন কী ভাবে, নতুন সংযোজন অঙ্কিতাই বা কে, তা তখনও জানতেন না ববিতা। পরে জানতে পারেন। তার পরই শুরু হয় তাঁর দৌড়ঝাঁপ।
র্যাঙ্কিংয়ের কার্ড নিয়ে ধর্নামঞ্চ থেকে শুরু করে এসএসসি কর্তৃপক্ষ— কোথাও যেতে বাকি রাখেননি ববিতা। এমনকি, তথ্য জানার অধিকার আইনেও প্রশ্ন করেছেন। জানতে চেয়েছেন, তাঁর এবং অঙ্কিতার প্রাপ্ত নম্বর কত?
ববিতা বিবাহিতা। তাঁর দুই সন্তানও আছে। গত পাঁচ বছর ধরে তাদের সামলে নিজের লড়াই চালিয়েছেন। বিপক্ষে যখন ‘প্রভাবশালী’ মন্ত্রী, তখন লড়াই যে কঠিন হবে, তা বুঝেছিলেন ববিতাও। কিন্তু হাল ছাড়েননি।
এক কালে ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন পরেশ। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। দল বদলে যখন ২০১৯ সালে তৃণমূলে এলেন, তখনও তাঁর ‘প্রভাব’ কমেনি।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ ছিল, মেয়ের চাকরি-সহ তিনটি শর্তেই তৃণমূলে এসেছিলেন পরেশ। পরে লোকসভা ভোটে হারলেও যখন বিধানসভায় জিতলেন, তখন তাঁকে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরেশ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হলে আরও কঠিন হয় ববিতার লড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছর পর পরেশকে যে সিবিআইয়ের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় এবং পরে সিবিআইয়ের মুখোমুখি হন, তার কারণ এই ববিতাই।
পরেশ-কন্যার নিয়োগ দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনার কৃতিত্ব এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদারকেও দিচ্ছেন অনেকে। কারণ হাই কোর্টে তিনিই জানিয়েছিলেন, পরেশের কন্যাকে অবৈধ ভাবে শিক্ষকতার চাকরি দেওয়ার কথা। কিন্তু শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ের ববিতা যদি তাঁর অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই চালিয়ে না যেতেন, তবে সিদ্ধার্থের একার পক্ষে মন্ত্রীর গোপন বন্দোবস্ত ফাঁস করা সম্ভব হত না।
আপাতত স্বস্তি পেলেন ববিতা। তবে বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে চাকরিতে যোগ দিলে।