অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে পশ্চিম দিল্লির তিলকনগর এলাকায় পুরসভার একটি স্কুলের কাছে বড় প্লাস্টিকে মোড়ানো অবস্থায় সুইৎজ়ারল্যান্ডের এক মহিলার দেহ উদ্ধার হয়। বিদেশিনির পচাগলা দেহ উদ্ধারকে কেন্দ্র করে হইচই পড়ে যায় দেশ জুড়ে। সেই খুনেরই তদন্তে নেমে হাড়হিম করা তথ্য প্রকাশ্যে আনল পুলিশ।
সুইৎজ়ারল্যান্ডের ওই মহিলার নাম নীনা বার্জার। নীনাকে খুনের অভিযোগে ইতিমধ্যেই তাঁর ভারতীয় প্রেমিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যে যুবকের বিরুদ্ধে সুইস বান্ধবীকে খুনের অভিযোগ উঠেছে, তিনি দিল্লির জনকপুরীর বাসিন্দা। মা-বাবা এবং বোনের সঙ্গে থাকেন। নাম গুরপ্রীত সিংহ।
পুলিশ জানিয়েছে, দিল্লি ঘুরিয়ে দেখানোর নাম করে সুইৎজ়ারল্যান্ড থেকে প্রেমিকা নীনাকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন গুরপ্রীত। ১১ অক্টোবর নীনা ভারতে আসেন। শহর ‘ঘুরিয়ে দেখানো’র আগে নীনাকে তাঁর প্রেমিক বলেছিলেন, “তোমার জন্য একটা বড় চমক আছে!” কিন্তু কী সেই চমক, তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি তরুণী।
প্রথমেই নীনার হাত-পা শিকলে বাঁধেন গুরপ্রীত। তার পর তাঁকে নিয়ে শহরের নানা জায়গায় ঘোরেন। সবশেষে, শাহপুর খাট্টায় বিষ্ণু গার্ডেন এলাকার একটি নির্জন জায়গায় গাড়িটি দাঁড় করান। অভিযোগ, সেখানেই সুইস তরুণীকে শ্বাসরোধ করে খুন করেন।
সূত্রের খবর, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নীনাকে গলা টিপে খুন করা হয়নি। খুন করা হয়েছিল পেশির জোরে প্লাস্টিকের ব্যাগ গলায় পেঁচিয়ে। সেই সময় নীনার হাত-পা এবং মুখ বাঁধা ছিল। যন্ত্রণায় হাত-পা ছুড়ছিলেন তিনি। নীনাকে ছটফট করতে দেখে অভিযুক্ত গুরপ্রীত নাকি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন।
সূত্রের খবর, একটু একটু করে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল নীনাকে। মৃত্যুর আগে প্রায় ৩০ মিনিট বাঁচার জন্য মরিয়া সংগ্রাম করতে হয়েছিল তাঁকে। শ্বাসরোধ করে খুন করার কারণে নাকি নীনার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল। নীনার দেহ দেখে নাকি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন গুরপ্রীত।
পুলিশ সূত্রে খবর, এর পর নীনার দেহ চালকের আসনের পাশের আসনে রেখে দেন অভিযুক্ত। কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেন জানলার কাচ। নীনার দেহ গাড়িতেই ফেলে রেখে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান গুরপ্রীত।
ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার দু’দিন পর আবার বিষ্ণু গার্ডেনে গিয়েছিলেন গুরপ্রীত। উদ্দেশ্য ছিল, নীনার মৃতদেহে পচন ধরেছে কি না তা দেখা। অভিযুক্ত দেখেন, ফেলে রেখে আসা গাড়ির ভিতর থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে।
দেহে পচন ধরেছে এটা বুঝতে পেরে গাড়ির ভিতর থেকে প্রেমিকার পচাগলা দেহ একটি বড় প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে পশ্চিম দিল্লির তিলকনগর এলাকায় পুরসভার একটি স্কুলের কাছে ব্যাগটি ফেলে আসেন। ২০ অক্টোবর তিলকনগর এলাকা থেকে ওই তরুণীর দেহ উদ্ধার হয়।
স্কুলের সামনে কে ওই দেহ ফেলে রেখে গেল, মৃত বিদেশিনিই বা কে, তা নিয়ে ধন্দে পড়ে পুলিশ। তন্দন্ত নেমে স্কুলের সামনের একটি সিসিটিভি ফুটেজ হাতে আসে পুলিশের। সেই ফুটেজ থেকে অভিযুক্তকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তের খোঁজ পাওয়া যায় জনকপুরী এলাকায়। তরুণীকে খুনের সন্দেহে গুরপ্রীতকে আটক করে পুলিশ। তার পরই তাঁকে জেরা করা শুরু হয়। তদন্তকারী এক আধিকারিকের দাবি, ক্রমাগত জেরার মুখে পড়ে শেষমেশ সুইস তরুণীকে খুনের কথা স্বীকার করেন গুরপ্রীত।
কেন খুন করলেন সুইস তরুণীকে? পুলিশের জেরায় গুরপ্রীত দাবি করেছেন, ২০২১ সালে জ়ুরিখে এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে একটি অনলাইন চ্যাটিং অ্যাপের মাধ্যমে নীনার সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। পরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
গুরপ্রীত নাকি পুলিশকে জানিয়েছেন যে, সুইস প্রেমিকার টানে বেশ কয়েক বার সুইৎজ়ারল্যান্ডেও গিয়েছিলেন তিনি। নীনার সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। বেশ কয়েক বার নীনাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতি বারই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন নীনা।
গুরপ্রীতের দাবি, গত সেপ্টেম্বর তিনি আবার জ়ুরিখে গিয়েছিলেন। আবারও বিয়ের প্রস্তাব দেন নীনাকে। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সায় দেননি নীনা। তার পরই দিল্লি ফিরে আসেন গুরপ্রীত। দেশে ফিরে নীনাকে দিল্লি আসার আমন্ত্রণ জানান। দিল্লি ঘুরিয়ে দেখানোর প্রস্তাব দেন। আর তাতে সাড়া দিয়েই দিল্লিতে আসেন নীনা।
পুলিশের অনুমান, গুরপ্রীত সন্দেহ করেছিলেন যে অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছেন নীনা। আর সেই কারণেই নাকি নীনাকে খুনের পরিকল্পনা করে তাঁকে ভারতে ডেকে পাঠান গুরপ্রীত। ভুয়ো পরিচয় ব্যবহার করে গাড়িও কিনেছিলেন।
নীনার টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়ার কারণেও তাঁকে খুনের ছক কষেছিলেন গুরপ্রীত। সেই তত্ত্বও একেবারে ফেলে দিতে পারছেন না তদন্তকারীরা। পুলিশ গুরপ্রীতের বাড়ি থেকে ২.২৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে।