আর ৪জি নয়, অক্টোবর মাস থেকেই দেশ জুড়ে বাণিজ্যিক ভাবে চালু হয়ে যেতে পারে পরীক্ষামূলক ৫জি পরিষেবা, এমনটাই জানালেন কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। সে দিকে লক্ষ্য রেখেই ২৬ জুলাই ৫জি স্পেকট্রামের নিলাম শুরু হয়েছিল।
মোট ১০টি ব্যান্ডের ৭২ হাজার ৯৮ মেগাহার্ৎজের স্পেকট্রাম নিলামে তোলার পর তার প্রায় ৭১ শতাংশই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রের দাবি অনুযায়ী, মোট দেড় লক্ষ কোটি টাকার স্পেকট্রাম বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাত পেয়েছে মুকেশ অম্বানীর সংস্থা রিলায়্যান্স জিয়ো। ৫জি স্পেকট্রামের ৮৮ হাজার ৭৮ কোটি টাকার বরাত পেয়েছে এই সংস্থা।
এই দৌড়ে পিছিয়ে থাকেননি শিল্পপতি গৌতম আদানিও। ২১২ কোটি টাকার বরাত পেয়েছে আদানির সংস্থা। ২৬ গিগাহার্ৎজ ব্যান্ডের স্পেকট্রাম কিনলেও সাধারণের জন্য তা ব্যবহার করা হবে না বলেই সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া ভারতী এয়ারটেল ৪৩ হাজার ৮৪ কোটি টাকার স্পেকট্রাম, ভোডাফোন ১৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার স্পেকট্রাম কিনেছে। কেন্দ্রের দাবি, সরকার এই ৫জি স্পেকট্রাম বণ্টনের পর প্রথম বছরে ১৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা উপার্জন করবে। নিলামে রিলায়্যান্স জিয়ো বিভিন্ন ব্যান্ডের ৭০০ মেগাহার্ৎজের স্পেকট্রাম কিনেছে। জানা গিয়েছে, এই স্পেকট্রামের সাহায্যে ৬-১০ কিলোমিটার পর্যন্ত সিগন্যাল পাওয়া যাবে।
পঞ্চম প্রজন্মের এই নেটওয়ার্ক পরিষেবা যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে চলেছে। ৫জি নেটওয়ার্ক কত দ্রুত পরিষেবা দিতে পারে, সেই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ৪জি পরিষেবার তুলনায় এর গতি ১০ গুণ বেশি। অর্থাৎ ৪জি যেখানে ১০০ এমবিপিএস গতি দিয়ে থাকে, সেখানে ৫জি ১০ জিবিপিএস গতিতে পরিষেবা দিতে সক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি সিনেমা ডাউনলোড করতে যদি ৪জি নেটওয়ার্কের ৪০ মিনিট সময় লাগে তবে ৫জি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেই সিনেমা ডাউনলোড করতে সময় লাগবে মাত্র ৩৫ সেকেন্ড। শুধু নেটওয়ার্কের দ্রুত গতিই নয়, ৫জি পরিষেবা পুরোদমে চালু হলে ‘অগমেন্টেড রিয়্যালিটি’ বা ‘মেটাভার্স’-এর সঙ্গেও আরও বেশি করে পরিচিতি ঘটবে মানুষের।
কোনও ব্যক্তি তাঁর পূর্বপুরুষের থ্রিডি অবতার তৈরি করে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ বার্তালাপও চালাতে পারবেন। বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছতে ড্রোনের ব্যবহার শুরু করা যাবে। ভারতের রাস্তায় দেখা যেতে পারে চালকবিহীন গাড়িও।
তবে, স্পেকট্রাম বণ্টনের সঙ্গে বিতর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ২০০৭ সালে সর্বপ্রথম ২জি স্পেকট্রাম বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেয় টেলিকম মন্ত্রক। তখন টেলিকম মন্ত্রীর পদে ছিলেন এ রাজা। মন্ত্রীপদে যোগদানের কয়েক মাসের মধ্যেই ২জি স্পেকট্রাম বণ্টনের বিষয়ে ঘোষণা করে টেলিকম মন্ত্রক।
সেই সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিংহ। তিনি টেলিকম মন্ত্রীকে নির্দেশ দেন, স্পেকট্রাম বণ্টনের ক্ষেত্রে যেন কোনও রকম গাফিলতি না হয়। লাইসেন্স ফি-সহ অন্যান্য বিষয়ে লক্ষ রেখেই সুষ্ঠু ভাবে সব সংস্থার মধ্যে বণ্টন করা হয়। এ ছাড়াও বণ্টন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখতে রাজাকে আরও অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু অর্থমন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কোনও নির্দেশই পালন করেননি টেলিকম মন্ত্রী। স্পেকট্রাম বিক্রির ঘোষণা প্রকাশ্যে আসার পর ৪৬টি সংস্থা থেকে মোট ৫৭৫টি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল।
কিন্তু টেলিকম মন্ত্রক এই বণ্টন নিলামের মাধ্যমে করেনি। বরং যে সংস্থা প্রথমে আবেদন করেছে সেই সংস্থাকেই বিক্রি করে দিতে শুরু করেছিল। পরে, আবার একই ব্যান্ডের স্পেকট্রাম টেলিকম মন্ত্রক থেকে অন্য সংস্থাকেও বিক্রি করা হচ্ছিল। সাধারণত, এক ধরনের স্পেকট্রাম বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহার করা যায় না।
তদন্ত শুরু হলে ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে সরকারি কোষাগারের ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা বলে অভিযোগ ওঠে। সুপ্রিম কের্টের রায়ের ভিত্তিতে মনমোহন মন্ত্রিসভার সদস্য ডিএমকের এ রাজা ও সাংসদ কানিমোঝিকে গ্রেফতার করা হয়৷ বিজেপি-সহ অন্য বিরোধীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘সরকারের অনৈতিক আচরণ ও দুর্নীতি’ নিয়ে৷
অন্য দিকে, বিজেপি এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এই স্পেকট্রাম বণ্টনের ঘটনা দেশের রাজনীতির ইতিহাসেও বদল এনে দেয়। এই প্রসঙ্গেই জানা যাক স্পেকট্রাম কী।
বিজ্ঞানের পরিভাষায় সংক্ষেপে বলা যায়, স্পেকট্রাম এক প্রকার তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের বৈশিষ্ট্যযুক্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্য, যার মাধ্যমে যে কোনও তথ্য এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে পারে। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ, যার পরিমাণও সীমিত।
স্পেকট্রামকে আপনি খালি চোখে দেখতে পাবেন না। সাধারণত স্পেকট্রাম বলতে মোবাইল নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্যকেই বোঝায়। বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য বিভিন্ন ব্যান্ডের ভিন্ন ভিন্ন স্পেকট্রাম ব্যবহৃত হয়।
২০১৪ সালে ৯০০ এবং ১৮০০ মেগাহার্ৎজ ২জি স্পেকট্রামের নিলাম শুরু হয়েছিল। কিন্তু, ২জি কেলেঙ্কারির পর সুপ্রিম কোর্ট ১৮০০ মেগাহার্ৎজ স্পেকট্রাম বণ্টনের প্রক্রিয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরকার ২জি স্পেকট্রাম নিলামের মাধ্যমে ৬১২ বিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রা অনুযায়ী, ৪৮০৮ কোটি ৮২ লক্ষ ৬ হাজার টাকা) উপার্জন করে।
২০১০ সালে ৩জি এবং ৪জি স্পেকট্রাম নিলামের মাধ্যমে সরকার ৬৭৭ বিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রা অনুযায়ী, ৫৩১৯ কোটি ৩৬ লক্ষ ১৬ হাজার ৩৫০ টাকা) উপার্জন করে। টাটা ডোকোমো প্রথম বেসরকারি সংস্থা হিসাবে ভারতে ৩জি পরিষেবা চালু করে।
রিলায়্যান্স জিয়োর পর ভোডাফোন এবং এয়ারটেল ৪জি পরিষেবার মাধ্যমে দেশবাসীর সঙ্গে দ্রুতগতির নেটওয়ার্কের পরিচয় ঘটিয়েছিল। এখন অবশ্য ৪জি-র চেয়েও দ্রুত পরিষেবা (৫জি) চালু হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন দেশবাসীরা।