দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। কিন্তু পিরামিড নয়। অনেকে বলেন, মায়া সভ্যতার পিরামিডের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। যদিও এ সব পিরামিড গড়ে উঠেছে তারও কয়েক হাজার বছর আগে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ফসল। নাম জ়িগুরাত। বার বার ধাক্কা দিয়েছে সময়, প্রকৃতি, যুদ্ধবিগ্রহ। তবুও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে জ়িগুরাত। বেঁচে উঠেছে ফিনিক্স পাখির মতো।
এই জ়িগুরাতকে দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো হলেও তাতে সিঁড়ি রয়েছে। মিশরে একদম প্রথম যুগে যে সব পিরামিড তৈরি হয়েছিল, সেগুলির সঙ্গে মিল রয়েছে জ়িগুরাতের। জ়িগুরাতে দুই থেকে সাতটি স্তর রয়েছে।
মেসোপটেমীয় সভ্যতায় কেন তৈরি করা হত এই জ়িগুরাত? ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, শহরের রক্ষক ‘ঈশ্বরের’ উদ্দেশ্যে তৈরি করা হত এগুলি।
ইতিহাসবিদদের মতে, উরের গ্রেট জ়িগুরাত তৈরি হয়েছিল চন্দ্রদেবতা নান্নার জন্য। ওই জ়িগুরাতের শীর্ষে নাকি থাকতেন খোদ দেবতা। সেটাই তাঁর শয়নকক্ষ ছিল। পুরোহিতেরা ওই কক্ষে বলি দিতেন, পুজো করতেন বলে মনে করা হয়।
ইরান এবং ইরাকে ছড়িয়ে রয়েছে বহু জ়িগুরাত। তবে সেগুলির বেশির ভাগই ভগ্নপ্রায়। মনে করা হয়, সব থেকে বড় জ়িগুরাত রয়েছে ব্যাবিলনে। তার উচ্চতা ৩০০ ফুট।
সময়ের আঁচ এসে পড়েছিল উরের গ্রেট জ়িগুরাতেও। ভগ্নপ্রায় হয়ে গিয়েছিল ৪০০০ বছরের পুরনো এই জ়িগুরাত। পরে তা বেশ কয়েক বার পুনর্গঠন করা হয়।
ইরাকের ধি কার প্রদেশে নাসিরিয়ার কাছে উরে রয়েছে এই গ্রেট জ়িগুরাত। উরের সম্রাট উর-নাম্মু এই জ়িগুরাত তৈরি করা শুরু করেছিলেন। শেষ করেছিলেন তাঁর ছেলে রাজা শুলগি।
ইতিহাসবিদদের মতে, উরের এই জ়িগুরাতে প্রশাসনিক ভবন তৈরি হয়েছিল। এখানে প্রশাসনিক কাজকর্ম চলত। মেসোপটেমীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল উর।
উরের এই জ়িগুরাতের নাম ছিল ‘এতেমেন্নিগুরু’। সুমেরু ভাষায় যার অর্থ ‘এমন মন্দির, যার ভিত্তি দারুণ এক পরিবেশ তৈরি করে’।
উরের জ়িগুরাতের উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। শহরের শীর্ষবিন্দু এটি। এখান থেকে প্রায় সারা শহর দেখা যায়।
উরের জ়িগুরাতের দৈর্ঘ্য ২১০ ফুট। প্রস্থ ১৫০ ফুট। তবে ৪০০০ বছর আগে এর উচ্চতা কত ছিল, তা আর জানা যায় না। কারণ এই জ়িগুরাতের মাথা ক্ষয়ে ভেঙে গিয়েছে।
এই উরের জ়িগুরাতের গঠনশৈলি দেখে আজও বিস্মিত হন ইতিহাসবিদেরা। এর ভিত্তি তৈরি হয়েছে কয়েক লক্ষ মাটির ইট দিয়ে। এক একটির ওজন প্রায় ১৫ কেজি।
নির্মাণের দেড় হাজার বছর পর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল উরের গ্রেট জ়িগুরাত। খ্রিস্ট জন্মের ৬০০ বছর আগে নব্য-ব্যাবিলনীয় যুগে পুনর্নির্মাণ করা হয় এটি। তখন সম্রাট নবোদিনাস ছিলেন ক্ষমতায়।
প্রথম যখন তৈরি হয়েছিল উরের জ়িগুরাত, তখন মাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছিল। বৃষ্টিতে সেই ইটে ক্ষয় ধরে। রোদে ফাটল ধরে। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, সে কারণেই ধসে গিয়েছিল উরের গ্রেট জ়িগুরাত।
নব্য ব্যাবিলনীয় যুগে যখন পুনর্নির্মাণ হয় এই জ়িগুরাতের, তখন সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে সংস্কারের সময় একের পর এক উপাদান যুক্ত করা হয় এই জ়িগুরাতে, যার সঙ্গে এর প্রাচীন নির্মাণের কোনও মিল নেই।
খ্রিস্ট জন্মের ৪০০ বছর আগে ইউফ্রেটিস নদী গতিপথ পরিবর্তন করে। মেসোপটেমীয় সভ্যতা এই টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর দান। সেই ইউফ্রেটিস নদীর গতিপথের পরিবর্তনের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় উর শহর।
উনিশ এবং বিশ শতকে এই উর শহর উদ্ধারের জন্য খননকাজ শুরু হয়। ১৯২০-১৯৩০ সাল নাগাদ লিওনার্দো উলির নেতৃত্বে এই শহরের খননকাজ পুরোপুরি শেষ হয়। মাটির নীচ থেকে উঠে আসে আস্ত শহর।
আশিক দশকে উরের জ়িগুরাত পুনর্নির্মাণ করান ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেন। সে সময় এর সিঁড়ি এবং একদম নীচের স্তরের সদর নতুন করে তৈরি করা হয়।
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দাম আমেরিকার বিমানহানা থেকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। উরের জ়িগুরাতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত বেশ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ। যাতে আমেরিকার বায়ুসেনা এই ঐতিহাসিক নিদর্শন ওড়ানোর চেষ্টা না করে।
তার পরেও বাঁচেনি জ়িগুরাত। অন্তত ৪০০টি বুলেটের দাগ রয়েছে এর গায়ে। আশপাশের বিস্ফোরণেও কেঁপে উঠেছিল এই সৌধ।