কথায় আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। গৌতম আদানির সুখী পরিবারের নেপথ্যেও এক নারীর ভূমিকা রয়েছে। তিনি শিল্পপতির ঘরনি প্রীতি আদানি। নিজের কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে যেমন সংসার সামলেছেন, আবার তেমনই স্বামীর ব্যবসাতেও হাল ধরেছেন প্রীতি। ‘‘স্ত্রী-ই তাঁর জীবনের স্তম্ভ’’, এ কথা নিজেই বলেছিলেন আদানি।
এখন সময় ভাল যাচ্ছে না আদানিদের। আমেরিকার লগ্নি গবেষণাকারী সংস্থা ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’-এর রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আঁধার ঘনিয়েছে আদানি পরিবারে। ওই সংস্থার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, কারচুপি করে নিজেদের সংস্থার শেয়ার দর বাড়িয়েছে আদানি গোষ্ঠী। আর এর জেরেই মুখ থুবড়ে পড়ছে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার।
পরিবারে যাবতীয় সমস্যার মোকাবিলায় স্ত্রীকে সর্বদাই সঙ্গে পান আদানি। বর্তমান সঙ্কট মোকাবিলায় উঠেপড়ে লেগেছে আদানি গোষ্ঠী। এই আবহে গৌতমের জীবনে স্ত্রীর কর্তব্য কী ভাবে পালন করেছেন প্রীতি, সে নিয়েই চর্চা চলছে বিভিন্ন মহলে।
গৌতম এবং প্রীতির বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে। দুই পরিবারের বড়রাই এই ‘রাজজোটক’ তৈরি করেছিলেন। প্রীতিকে প্রথম দেখার সময় বেশ লাজুক ছিলেন গৌতম। এক সাক্ষাৎকারে আদানি বলেছিলেন, ‘‘আমি এক জন অশিক্ষিত, আর তিনি (প্রীতি) চিকিৎসক। সুতরাং একটু তো বেমানান বটেই।’’
১৯৬৫ সালে মুম্বইয়ে গুজরাতি পরিবারে জন্ম প্রীতির। আমদাবাদে সরকারি দন্ত্য কলেজ থেকে দন্ত্য শল্য চিকিৎসায় স্নাতক হয়েছিলেন তিনি। তবে আদানির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পর নিজের কেরিয়ার নিয়ে আর ভাবেননি। নিজের পেশা ছেড়ে মন দিয়েছিলেন সংসারে।
তবে স্বামীর ঘর করতে গিয়ে কেরিয়ার বিসর্জন দেওয়ার জন্য মনের মধ্যে কোনও ক্ষোভ ছিল না প্রীতির। আদানির ৬০তম জন্মদিনে টুইটারে প্রীতি লিখেছিলেন, ‘‘৩৬ বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেল...আমার কেরিয়ারকে পাশে সরিয়ে গৌতম আদানির সঙ্গে নতুন যাত্রা শুরু করেছিলাম। এখন যখন পিছন ফিরে তাকাই, ওকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করি।’’
শুধু গৃহবধূ হয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাননি প্রীতি। গৌতমকে বিয়ের পর ১৯৯৬ সালে আদানি ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন হন তিনি। প্রীতির নেতৃত্বে ফাউন্ডেশনের যে প্রভূত উন্নতি হয়েছে, সে কথা বলেছেন খোদ আদানি।
স্ত্রীর প্রশংসা বরাবরই করতে দেখা গিয়েছে আদানিকে। প্রীতি সম্পর্কে গৌতম বলেছিলেন, ‘‘ও আমার জীবনের স্তম্ভ। আমার পরিবারের দেখভাল করে। আমার সন্তান, নাতনির খেয়াল রাখে। আদানি ফাউন্ডেশনের কাজও সামলাচ্ছে। নিজের কেরিয়ার ছেড়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। ওর নেতৃত্বেই ফাউন্ডেশনের অনেক উন্নতি হয়েছে।’’
আদানি ফাউন্ডেশন যখন তৈরি হয়েছিল, তখন সেখানে মাত্র ২ জন কর্মী কাজ করেছেন। আর এখন দেশ জুড়ে ওই সংস্থাই বছরে ৩২ লক্ষ মানুষকে সাহায্য করছে। এর নেপথ্যে প্রীতির অবদানকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন আদানি।
আদানির সংসারে প্রীতি বেশ লক্ষ্মীমন্ত। প্রীতির নেতৃত্বেই ২০১৮-১৯ সালে আদানি গোষ্ঠীর সিএসআর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি) বাজেট ছুঁয়েছিল ১২৮ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ সালে এই অঙ্কটা ছিল ৯৫ কোটি টাকা।
সব সময় মানুষের জন্য কিছু করতে মুখিয়ে থাকেন প্রীতি। ২০০১ সালে গুজরাতের ভুজে ভূমিকম্পের পর মুন্দ্রা এলাকায় ‘আদানি ডিএভি স্কুল’ শুরু করেছিলেন তিনি। শিশুরা যাতে যথাযথ শিক্ষা পায়, সেই লক্ষ্যেই এই স্কুলের পথচলা শুরু হয়।
তাঁদের স্কুলে পিছিয়ে পড়া শিশুরা যাতে বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষা পায়, সে কথা কয়েক বছর আগেই ঘোষণা করেছিলেন প্রীতি। গৌতম-পত্নীর এই ভূমিকাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই।
করোনা অতিমারির সময়ও প্রীতির ভূমিকা আলাদা ছাপ ফেলেছে সমাজে। গরিবদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দিয়েছিলেন তিনি। করোনা যোদ্ধাদের জন্য পিপিই কিটও দিয়েছিল প্রীতির আদানি ফাউন্ডেশন।
সমাজে কল্যাণমূলক কাজের জন্য ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আমদাবাদের জিএলএস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ডক্টরেট সম্মান দেওয়া হয় প্রীতিকে।
এত কিছু কাজের মধ্যেই যত্ন করে নিজের সংসার সাজিয়েছেন প্রীতি। দুই পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনিদের নিয়ে ভরা সংসার প্রীতির। গৌতম এবং প্রীতির দুই পুত্র রয়েছে। তাঁরা হলেন করণ এবং জিৎ আদানি। ২০১৩ সালে করণের সঙ্গে বিয়ে হয় পরিধির। ২০১৬ সালে তাঁদের কন্যাসন্তান হয়।
আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেডের চিফ এগ্জ়িকিউটিভ অফিসার করণ। কনিষ্ঠ পুত্র জিৎ পেনসিলভানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
শত ব্যস্ততার ফাঁকেও নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে ভোলেন না প্রীতি। নতুন খেলনা এনে দেওয়া হোক বা তার সঙ্গে সময় কাটানো, পুরোদস্তুর ঠাকুমার দায়িত্বই পালন করছেন প্রীতি।
দিনের অধিকাংশ সময়টাই ফাউন্ডেশনের জন্য বরাদ্দ রাখেন প্রীতি। এ ছাড়াও বাগানের পরিচর্যা কিংবা বই পড়ার অভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত রাখেন না।
ব্যবসায়ী পরিবারের ঘরনি। তার পর আবার নিজেও ব্যবসা সামলান। পাশাপাশি সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি তাঁর নখদর্পণে থাকে। এত কিছুর মধ্যেও নিজেরা একান্তে সময় কাটাতে ভোলেন না গৌতম এবং প্রীতি।
এক সাক্ষাৎকারে গৌতম জানিয়েছিলেন, আমদাবাদে যখন ৪ দিনের জন্য থাকেন, তখন দেরি করে অফিস যান। পরিবারকে যাতে বেশি করে সময় দিতে পারেন, সে কারণেই অফিসে ঢোকেন দেরিতে।
তাঁর কথায়, ‘‘রাতে যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরি, প্রীতির সঙ্গে তাস খেলি, রামি খেলি। ৮-১০ রাউন্ড খেলি। তবে অধিকাংশ সময়ই প্রীতি জেতে।’’ একেবারে যেন সুখী পরিবার।
তবে আদানির সেই সুখী পরিবারেই বিপদ ঘনিয়েছে। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই পরিস্থিতি সামলে কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন তাঁরা? এই নিয়ে যখন নানা চর্চা চলছে, তখন আদানি-ঘরনির কথা উঠে আসছে আলোচনার টেবিলে।