১৪ জুলাই ঠিক দুপুর ২টো ৩৫ মিনিট। ইতিহাস গড়ার পথে প্রথম পা বাড়িয়েছিল চন্দ্রযান-৩। শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে চাঁদের উদ্দেশে উড়ে গিয়েছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর এই মহাকাশযান। দিনরাত এক করে, নাওয়া-খাওয়া-ঘুম ত্যাগ করে একে একে ৪০ দিন কাটিয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। নজর রাখেছিলেন চন্দ্রযান-৩-এর গতিবিধির উপর। অপেক্ষায় ছিলেন আপামর দেশবাসী। ইতিহাস তৈরির মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী থাকবেন বলে। অবশেষে অবসান হল সেই অপেক্ষার। ভাসতে ভাসতে ‘চাঁদের বাড়ি’ পৌঁছল ল্যান্ডার বিক্রম। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের মাটি ছুঁয়ে জানান দিল ভারতীয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিশাল অস্তিত্ব।
চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের পর সারা দেশে উৎসবের মেজাজ। আতশবাজি পুড়িয়ে ভারতের সাফল্য উদ্যাপনে মেতেছেন সাধারণ মানুষ। আবেগে ভেসেছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। তৃতীয় বিশ্বের দেশের চোখ টাটিয়ে দেওয়া সাফল্যে শুভেচ্ছাবার্তা ভেসে আসছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি থেকেও।
চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ নিয়ে মেতে উঠেছিল সারা দেশে। অবতরণ নিয়েও দেখেছে। এই দুই ঘটনা ইতিহাসের বুকে জ্বলজ্বল করবে। কেমন ছিল চন্দ্রযান-৩-এর যাত্রাপথ? কেমন ভাবেই বা প্রতি মুহূর্তের উৎকণ্ঠায় কাটাচ্ছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা? চন্দ্রযানের যাত্রাপঞ্জি রইল আনন্দবাজার অনলাইনের পাতায়।
২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২-এর ব্যর্থতার পর এক ধাক্কায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় ইসরোর চাঁদের মাটি ছোঁয়ার স্বপ্ন। কান্নায় ভেঙে পড়েন ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান কে শিবন। কিন্তু দমে যাননি ইসরোর বিজ্ঞানীরা। মনখারাপ সরিয়ে চন্দ্রযান-৩-এর কাজে হাত লাগায় ইসরো। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে চাঁদের মাটি ছোঁয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ইতিহাস তৈরির লক্ষ্যে নতুন করে পথ চলা শুরু করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে ইসরো এই প্রকল্পটি শুরুর জন্য কেন্দ্রের কাছে প্রাথমিক ভাবে ৭৫ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রার্থনা করেছিল ইসরো। যার মধ্যে ৬০ কোটি অত্যাধুনিক সরঞ্জাম এবং অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য এবং বাকি ১৫ কোটি রাজস্ব ব্যয়ের জন্য চাওয়া হয়। টাকা পেয়ে কাজ শুরু করে ইসরো।
চন্দ্রযান-১ এবং চন্দ্রযান-২-এর মতোই চন্দ্রযান-৩ খুব ব্যয়বহুল অভিযান ছিল না। অন্তত আমেরিকা বা রাশিয়া চাঁদের অভিযানে যে অর্থ খরচ করে, তার তুলনায় অনেক কম। চন্দ্রযান-৩-এর বাজেট ছিল ৬১৫ কোটি টাকা।
সাড়ে তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ইসরোর তরফে ঘোষণা করা হয় ১৪ জুলাই চাঁদের দেশে পাড়ি দেবে চন্দ্রযান-৩।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৪ জুলাই চন্দ্রযান-৩ শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে যাত্রা শুরু করে। ইসরোর এই চন্দ্রযানের কেন্দ্রে ছিল এলভিএম-৩ রকেট। যা চন্দ্রযানটিকে শক্তি জুগিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। এলভিএম-৩ একটি ত্রিস্তরীয় উৎক্ষেপণ যান। এর আগে একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ এবং চন্দ্রযাত্রায় এই এলভিএম-৩ ব্যবহৃত হয়েছে। একে ভারতীয় রকেটের ‘বাহুবলী’ বলা হয়।
এলভিএম-৩ রকেটের মধ্যে দু’টি স্তরে কঠিন জ্বালানি এবং একটি স্তরে তরল জ্বালানি ছিল। কঠিন জ্বালানি ১২৭ সেকেন্ড ধরে জ্বলে। উৎক্ষেপণের ১০৮ সেকেন্ডের মধ্যে জ্বলতে শুরু করেছিল তরল জ্বালানি। তা ২০৩ সেকেন্ড ধরে রকেটটি চালনা করে।
এর পর ধীরে ধীরে গন্তব্যের দিকে এগোতে থাকে চন্দ্রযান-৩। পৃথিবীর টান কাটিয়ে একের পর এক কক্ষপথ অতিক্রম করতে থাকে সেটি। সফল হয় কক্ষপথ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।
১৫ জুলাই পৃথিবীর প্রথম কক্ষপথ পেরিয়েছিল চন্দ্রযান-৩। উৎক্ষেপণের পর চাঁদের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় বার যানটি কক্ষপথ পরিবর্তন করে ১৭ জুলাই।
এর পর ১৮ জুলাই, ২০ জুলাই এবং ২৫ জুলাই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের গণ্ডি ছাড়িয়ে তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম কক্ষপথ অতিক্রম করে চন্দ্রযান ৩।
৩১ জুলাই পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে নিজের গতি বাড়িয়ে চাঁদের কক্ষের উদ্দেশে পাড়ি দেয় চন্দ্রযান-৩। অর্থাৎ, উৎক্ষেপণের ১৭ দিনের মাথায় পৃথিবীর সমস্ত টান কাটিয়ে বেরিয়ে যায় মহাকাশযানটি।
চন্দ্রযান-৩ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে ৫ অগস্ট। ৩১ জুলাই থেকে ৫ অগস্ট অর্থাৎ, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশের মাঝের এই ছ’দিন উৎকণ্ঠায় কেটেছিল ইসরোর বিজ্ঞানীদের।
ইসরোর বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ছিল, অঙ্কের সামান্য ভুলে যদি চন্দ্রযান-৩ শেষ পর্যন্ত চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছতে না পারে, তবে তা আবার ঘুরে চলে আসবে পৃথিবীর কক্ষপথে। কিন্তু সেখান থেকে তাকে আবার চাঁদে পাঠানোর মতো জ্বালানি আর থাকবে না। সে ক্ষেত্রে চন্দ্রযান-৩কে ‘লস্ট মিশন’ বা ব্যর্থ অভিযান বলেই ধরে নেওয়া হবে। তবে তা হয়নি। নির্ঝঞ্ঝাটেই চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে চন্দ্রযান-৩।
এর পর ধীরে ধীরে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহের দিকে এগিয়ে চলে মহাকাশযানটি। চাঁদের চারদিকে পাক খেতে খেতে ক্রমশ গতি কমাতে থাকে চন্দ্রযান-৩।
৫ অগস্ট থেকে ১৬ অগস্ট পর্যন্ত চন্দ্রযান-৩ একটি একটি করে চাঁদের কক্ষপথ নির্বিঘ্নে পেরোতে থাকে। এর মধ্যেই ৬ অগস্ট বাইরের দিক থেকে চাঁদের দ্বিতীয় কক্ষপথে প্রবেশ করে গন্তব্যের ছবি তুলে ফেলেছিল চন্দ্রযান-৩।
ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায় চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা গিরিখাত— এডিংটন, পিথাগোরাস, অ্যারিস্টারকাস, রমনকে। ছবিতে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা ‘ওসিয়ানাস প্রোজেলেয়ারাম’। যাকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ‘ঝড়ের সমুদ্র’ও বলে থাকেন। এই ‘সমুদ্র’ আসলে জলের সমুদ্র নয়। গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা এই গিরিখাতকেই পৃথিবী থেকে ‘চাঁদের কলঙ্ক’ হিসাবে দেখি আমরা। ছবিটি তুলেছিল চন্দ্রযান-৩-এ থাকা ল্যান্ডার হরাইজ়েন্টাল ভেলোসিটি ক্যামেরা (এলএইচভিসি)।
১৭ অগস্ট আরও গন্তব্য চাঁদের দিকে আরও এক ধাপ এগোয় চন্দ্রযান-৩। মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিক ভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় ১৭ অগস্টেই। রোভার প্রজ্ঞানকে পেটে নিয়ে ধীরে ধীরে চাঁদের দিকে নামতে শুরু করে ল্যান্ডারটি। প্রাথমিক ভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে অবস্থান করছিল বিক্রম।
এর পর চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দুর্গম খানাখন্দে ভরা মাটিতে অপেক্ষাকৃত মসৃণ জমি খোঁজার কাজ শুরু করে বিক্রম। সেই জমি খুঁজে পেতেই পেরিয়ে যায় কয়েকটি দিন। এর মাঝে চন্দ্রপৃষ্ঠের একের পর এক ছবি তুলে ইসরোতে পাঠাতে থাকে চন্দ্রযান-৩।
ভাসতে ভাসতেই অবতরণের উপযুক্ত জমি খুঁজে পেয়েছিল ল্যান্ডার বিক্রম। ২৩ অগস্ট রোভার প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতরে নিয়ে সেখানেই ‘পাখির পালকের মতো অবতরণ’ (সফ্ট ল্যান্ডিং) শুরু করে সেটি। চার বছর আগে ঠিক যে পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হয়েছিল ইসরোর ‘চন্দ্রযান-২’। কিন্তু চন্দ্রযান-৩ বিফলে গেল না।
ইসরোর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিট নাগাদ চাঁদের মাটিতে নেমে ইতিহাস তৈরি করল ভারতের চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। দেশ জুড়ে হইহই, আনন্দ, বাজি পোড়ানো। সমাজমাধ্যমে হাজারো পোস্টের বন্যা। আবার কান্নায় ভাসলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। অনেক দিনের দলা পাকানো কান্না। তবে এই কান্না আনন্দের, তৃপ্তির, আত্মবিশ্বাসের। সে কান্না ভারতকে ‘জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে’ বসানোর আনন্দে।