ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিশু যৌন কেলেঙ্কারি বললেও অত্যুক্তি হয় না। কমপক্ষে ২৯৯ জন রোগীকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ ফ্রান্সের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে যে সব রোগীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, তাদের বেশির ভাগই শিশু এবং তাদের অনেককেই অচেতন অবস্থায় যৌন নিপীড়ন করা হত বলে ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে।
জোয়েল লে স্কুয়ার্নেক। ফ্রান্সের স্বনামধন্য শল্য চিকিৎসক। অথচ সেই শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত মুখের আড়ালে লুকোনো ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চেহারা। অভিযোগ, ২৫ বছর ধরে চিকিৎসকের রূপ ধরে একের পর এক নারকীয় ঘটনা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি।
৭৪ বছরের এই বৃদ্ধ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ১১১টি ধর্ষণ এবং ১৮৯টি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। শিশুরাই মূলত তাঁর বিকৃত কামের শিকার হত। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, ২৯৯ জনের মধ্যে ২৫৬ জনই শিশু ছিল এবং তাদের বয়স ১৫ বছরের কম।
জোয়েলের শিকারদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি ছিল এক বছরের একটি শিশু। তাঁর যৌন লালসার হাত থেকে রেহাই পায়নি সেই একরত্তিও। ৭০ বছর বয়সি এক বৃদ্ধাকেও তাঁর লালসার শিকার হতে হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে।
২০১৭ সালে ৬ বছর বয়সি এক প্রতিবেশীকে ধর্ষণের পর এই চিকিৎসকের মুখোশ খসে পড়ে। অভিযোগ পেয়ে পশ্চিম ফ্রান্সের পুলিশ জোয়েলের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে হতবাক হয়ে যায়। চিকিৎসকের ঘর থেকে উদ্ধার হয় সঙ্গমের জন্য ব্যবহৃত পুতুল, পরচুলা এবং শিশু পর্নোগ্রাফির সিডি। সে সবের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, তা দেখে চোখ কপালে উঠে যায় তদন্তকারী আধিকারিকদেরও।
ফরাসি পুলিশ জানিয়েছিল, তল্লাশিতে তারা একটি ইলেকট্রনিক ডায়েরিও উদ্ধার করেছে। এই ডায়েরিতে প্রায় তিন দশক ধরে এই অঞ্চলের হাসপাতালগুলোয় শত শত রোগিনীর ওপর তাঁর ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে।
এক শিশু প্রতিবেশী, তাঁর দুই ভাগ্নী ও চার বছর বয়সি এক রোগীকে ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের অভিযোগে স্কুয়ার্নেককে ২০২০ সালে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এখন কারাগারের অন্তরালেই দিন কাটছে তাঁর।
২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের একটি আদালতে ৭৪ বছর বয়সি স্কুয়ার্নেকের বিরুদ্ধে ভয়াবহ শিশু যৌন নির্যাতন মামলায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে।
২০০৫ সালে শিশু পর্নোগ্রাফির জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও স্কুয়ার্নেক ২০১৭ সালে গ্রেফতারির আগে পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে কাজ চালিয়ে যান। এ ব্যপারে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে কারণ জানতে চায় রয়টার্স। তার কোনও উত্তর দেওয়া হয়নি সরকারের তরফে।
অভিযোগ ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জোয়েল যৌন নিপীড়নের এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন। সেই সময় তিনি পশ্চিম ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে কাজ করতেন। পেশা ও পদের অপব্যবহার করে তিনি দু’দশকের বেশি সময় ধরে কুকীর্তি চালিয়ে যান বলে অভিযোগ।
২০০৫ সালে শিশু পর্নোগ্রাফি রাখার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে জোয়েলকে চার মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরের বছর তিনি কুইম্পেরেল পাবলিক হাসপাতালে শল্য চিকিৎসক হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন।
২০১৭ সালে লে স্কুয়ার্নেকের ডায়েরির সন্ধান পাওয়ার পর তদন্তকারীরা হাসপাতালের রেকর্ডের সঙ্গে ডায়েরির বর্ণনা মিলিয়ে সম্ভাব্য নির্যাতিতাদের খুঁজে বার করতে শুরু করেন। যদিও অনেক রোগী অজ্ঞান থাকায় তাঁদের ঘটনার কথা মনে ছিল না।
এমনই এক রোগীর কথা রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০৭ সালে ম্যাথিস ভিনেটের বয়স যখন ১০ বছর, তখন এক বার তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তখন তার বাবা এবং ঠাকুরদা তাকে কুইম্পেরেল হাসপাতালে নিয়ে যান। রাতে তাকে সেখানেই ভর্তি করা হয়। সে সময় সেখানে ছিলেন জোয়েলও। তাঁকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে নাতিকে রাতে হাসপাতালে একা রেখে বাড়ি ফিরে আসেন ৭৮ বছর বয়সি রোল্যান্ড ভিনেট।
আদালতের নথি অনুসারে, স্কুয়ার্নেক তাঁর ডায়েরিতে একই দিন এবং তার পরের দিন একটি ছোট ছেলেকে যৌন নির্যাতনের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রতি বারই রোগীর যৌনাঙ্গে অনুপযুক্ত ভাবে স্পর্শ করেছিলেন তিনি। এ কথা নিজেই জোয়েল লিখেছেন ডায়েরিতে।
রোল্যান্ড ভিনেট জানিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ম্যাথিস আর আগের মতো ছিল না। পরবর্তী জীবনে সে মদ্যপান এবং মাদকাসক্তিতে ডুবে যায়। পুলিশের কাছ থেকে নানা তথ্য জানার পর তার মনে আবার সেই নির্যাতনের স্মৃতি ফিরে আসে।
এর তিন বছর পর ২০২১ সালে অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের ফলে মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান ম্যাথিস। রোল্যান্ড ভিনেট এবং তাঁর স্ত্রী মনে করেন, ম্যাথিস আত্মহত্যা করেছেন। তাঁরা তাঁদের নাতির মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে স্কুয়ার্নেককেই দোষী মনে করেন।
সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি আদালতে জোয়েলের বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে বন্ধ দরজার ভিতর। যাঁরা সাক্ষ্য দেবেন, তাঁরা শিশু বয়সে জোয়েলের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যদি জোয়েল দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তাঁর সর্বোচ্চ ২০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
জোয়েলের মতো আরও এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে উঠেছিল ভয়ঙ্করতম শিশু ও মহিলা রোগীদের নির্যাতনের অভিযোগ। সেই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে নড়েচড়ে বসেছিল নরওয়ে প্রশাসন। আর্নে বাই নামের নরওয়ের বাসিন্দা ৫৫ বছরের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল ৮৭ জন মহিলাকে ধর্ষণ করার। ভয়াবহ সব অভিযোগ জমা পড়েছিল আর্নের বিরুদ্ধে।
আর্নের বিরুদ্ধে মোট ৯৪ জন মহিলাকে যৌন নিগ্রহ ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭ জন তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। টানা দু’দশকের বেশি সময় ধরে জোয়েলের মতো তিনিও এই কুকীর্তি চালিয়ে যান বলে অভিযোগ।