এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! আমেরিকার থেকে অস্ত্র পাওয়ার আশায় যখন হাপিত্যেশ করে বসে নয়াদিল্লি, তখনই পাশে এসে দাঁড়াল ফ্রান্স। ভারতকে হাতিয়ার বিক্রির পাশাপাশি ১০০ শতাংশ প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে ইমানুয়েল মাকরঁর দেশ।
সূত্রের খবর, চলতি বছরেই নয়াদিল্লির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে চাইছে ফরাসি প্রশাসন। যা চূড়ান্ত রূপ পেলে তিন ধরনের হাতিয়ার পাবে ভারতীয় ফৌজ। সেগুলি হল, পরমাণু ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন), জলের নীচের ড্রোন এবং যুদ্ধবিমানের ১১০ কিলো নিউটন থ্রাস্টের ইঞ্জিন।
বর্তমানে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘তেজস’ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভারতীয় বায়ুসেনা। যা আরও বেশি সংখ্যায় তৈরি করে দ্রুত বায়ুসেনার হাতে তুলে দিতে চাইছে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল)। এই যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন আমেরিকা থেকে আসার কথা রয়েছে।
কিন্তু, জেট বিমানের ইঞ্জিন নয়াদিল্লির হাতে তুলে দিতে ওয়াশিংটন অযথা দেরি করছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি এবং সেগুলির প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁর কূটনৈতিক উপদেষ্টা ইমানুয়েল বোনের সঙ্গে ভারত-ফ্রান্স কৌশলগত সম্পর্ক নিয়ে বৈঠক করবেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। এর জন্য প্যারিস উড়ে যাচ্ছেন তিনি। ১ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে ওই বৈঠক।
এ বছরের জানুয়ারিতে ভারত সফরে আসেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁ। তাঁর সেই সফরের পর প্যারিসের সঙ্গে প্রথম বার দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত বৈঠকে বসছে নয়াদিল্লি। আলোচনা শুরুর মুখে ফ্রান্সের হাতিয়ার সরবরাহ সংক্রান্ত প্রস্তাব এর গুরুত্ব কয়েক গুণ বাড়িয়েছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
সম্প্রতি নিস নৌঘাঁটিতে মহড়া চলাকালীন জলের নীচের ড্রোন ব্যবহার করে সারা দুনিয়াকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয় ফরাসি ফৌজ। বর্তমানে বিশ্বের খুব কম দেশের হাতে রয়েছে এই ‘আন্ডারওয়াটার ড্রোন’। শত্রুর উপর নজরদারি ও চুপিসারে হামলা, দু’টি কাজেই এগুলিকে ব্যবহার করা যায়।
গত কয়েক বছর ধরেই সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। যার পোশাকি নাম ‘অ্যাডভান্স মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট’ বা ‘অ্যামকা’। এখনও এই যুদ্ধবিমানের জন্য উন্নত প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন তৈরি করতে পারেনি নয়াদিল্লি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, ফ্রান্সের থেকে ১১০ কিলো নিউটন থ্রাস্টের ফাইটার ইঞ্জিন হাতে পেলে অ্যামকা তৈরিতে গতি আসবে। ওই ইঞ্জিন তেজসেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এর প্রযুক্তি পুরোপুরি হস্তান্তরিত হলে ইঞ্জিনগুলি ভারতেই তৈরি করা যাবে। সে ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলেও মনে করছেন তাঁরা।
সূত্রের খবর, এ বারের সফরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁর সঙ্গেও দেখা করবেন ডোভাল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে ভারতে কী কী পদক্ষেপ করছে, তা ব্যাখ্যা করবেন তিনি। মস্কো যাতে যুদ্ধ বন্ধ করে, তার জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ইঙ্গিত আগে থেকেই দিয়ে রেখেছে ফ্রান্স।
চলতি মাসে রাশিয়া সফরেও যান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডোভাল। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। গত ২৩ অগস্ট ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দু’জনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে কী কী আলোচনা হয়েছে, তা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ডোভাল জানান বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
এ বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁর সঙ্গে ভারতে আসেন ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকর্নু। ওই সময়ে তাঁর সঙ্গে সামরিক কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে আলোচনা করেন ডোভাল। সূত্রের খবর, এই ইস্যুতে তাঁকে একটি চিঠিও দিয়েছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
ভারতীয় নৌসেনা দীর্ঘ দিন ধরেই কেন্দ্রকে অন্তত দু’টি পরমাণু ডুবোজাহাজের (নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন) কথা বলে আসছে। এই পরিস্থিতিতে প্যারিসের প্রস্তাব লাভজনক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ফ্রান্স হাতিয়ার বিক্রি ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে যে ভারতের আকাশ-ভূমি ও সমুদ্রের নীচে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি ও শত্রুর উপর প্রত্যাঘাতের ক্ষমতা বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
ফ্রান্স সফরকালে ডোভাল সাফরান ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী সংস্থার চেয়ারম্যান রস ম্যাকিনেসের সঙ্গেও দেখা করতে পারেন। গত সপ্তাহে ভারতে এসেছিলেন কলকাতায় জন্ম হওয়া ম্যাকিনেস। নরেন্দ্র মোদী সরকারকে একটি বিশেষ প্রস্তাব দেন তিনি। ডোভাল যা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন বলে মনে করা করা হচ্ছে।
সত্তরের দশকে ফরাসি সংস্থা সাফরানের সাহায্যেই রকেটের ইঞ্জিন তৈরি করেছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। এ বার এই সংস্থা অ্যামকার জন্য ১১০ কিলো নিউটন থ্রাস্টের ইঞ্জিনের নকশা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি, ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারদের জেট ইঞ্জিন নির্মাণের কলাকৌশল শেখানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে এই ফরাসি সংস্থা।
হাতিয়ার বিক্রি ও প্রযুক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের দেওয়া প্রস্তাবের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এর উপর ভারতের পূর্ণ অধিকার থাকবে। অর্থাৎ, ওই জেট ইঞ্জিন ইচ্ছামতো অন্য কোনও দেশকে বিক্রিও করতে পারবে নয়াদিল্লি।
রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সুপারসনিক ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে ভারত। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ওই হাতিয়ার অন্য দেশকে বিক্রি করতে হলে ভারতকে পেতে হবে মস্কোর সবুজ সঙ্কেত। অস্ত্র প্রযুক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে ফ্রান্স ভারতকে পুরোপুরি ছাড়ের প্রস্তাব দেওয়াকে তাই দারুণ প্রস্তাব বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
স্বাধীনতার পর ভারতকে উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম হল ফ্রান্স। দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারি রয়েছে। ভারতীয় নৌসেনা নেপোলিয়নের দেশ থেকে ২৬টি রাফাল মেরিটাইম ফাইটার জেট কিনতে আগ্রহী। যা নিয়ে আলোচনা চলছে। ওই যুদ্ধবিমানগুলি হাতে পেলে তা আইএনএস বিক্রান্ত ও আইএনএস বিক্রমাদিত্য নামের দু’টি বিমানবাহী রণতরীতে মোতায়েন করবে ভারতীয় নৌসেনা।
আগামী দিনে ফ্রান্সের সহযোগিতায় আরও তিনটি কালভেরি শ্রেণির ডিজ়েলচালিত ডুবোজাহাজ তৈরি করবে ভারত। যা নয়াদিল্লির ‘প্রজেক্ট ৭৫’-এর অংশ। এ ছাড়া ফ্রান্সের থেকে উন্নত ফাইটার জেট কিনতে পারে ভারতীয় বায়ুসেনা।