মহামারির কোপ এড়াতে পাড়ি দিয়েছিলেন ভিন্রাজ্যে। রোজগারের তাগিদে ছোট্ট একটি মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন। তাতে রেখেছিলেন নিজের হাতে গড়া পেঁড়া। তবে দোকান খুলতে না খুলতেই নাকি নিমেষে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল জনৈক রামরতন সিংহ ঠাকুরের তৈরি সেই মিষ্টি।
১৭৫ বছরের বেশি আগেকার ওই দোকানের সেই মিষ্টি আজ ‘ধারওয়াড় পেঁড়া’ নামে জগদ্বিখ্যাত। কী তার জন্মকাহিনি? তা জানতে ফিরে যেতে হবে উনিশ শতকের শেষের বছরগুলিতে।
ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে গোটা দুনিয়ার মতো এ দেশেও মহামারির আকার নিয়েছিল প্লেগ। ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন বম্বে প্রেসিডেন্সিতে বুবোনিক প্লেগে আক্রান্ত দেশের প্রথম রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ধীরে ধীরে কলকাতা থেকে করাচি, পুণে থেকে পঞ্জাব, হায়দরাবাদ থেকে মহীশূর— সর্বত্র তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
মহামারির কোপে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল। প্লেগের সংক্রমণ এড়াতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভিটেমাটি ছেড়েছিলেন বহু বাসিন্দা। সে সময় উত্তরপ্রদেশের উন্নাও শহর ছেড়ে সপরিবার ভিন্রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন রামরতন। পরিবার নিয়ে কর্নাটকের ধারওয়াড় জেলায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি।
সংসার চালাতে ধারওয়াড়ের একটি বাজারের একচিলতে ঘরে মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন রামরতন। গো়ড়ায় তাতে রেখেছিলেন নিজের হাতে গড়া পেঁড়া। সে পেঁড়া তৈরি করতে ধারওয়াড়ি মোষের দুধ ব্যবহার করতেন তিনি।
মোষের দুধের জন্য ধারওয়াড়ের খ্যাতি কম নয়। এলাকার আশপাশে গবলী সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা ধারওয়াড়ি মোষ পালন করতেন। তাঁদের কাছ থেকে সেই দুধ কিনে মিষ্টি তৈরির কাজে লেগে পড়েছিলেন রামরতন।
পেঁড়া তৈরির জন্য ধারওয়াড়ি দুধ জাল দিয়ে থকথকে গাঢ় করার সময় তাতে চিনি এবং ময়দা ঢেলে দিতেন। সঙ্গে থাকত রামরতনের নিজস্ব রেসিপি। ১৭৫ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সে রেসিপি ‘ফাঁস’ হয়নি বলে দাবি।
রামরতনের হাতে গড়া পেঁড়ার স্বাদ চাখতে বেশ ভিড় হত। ধীরে ধীরে তাঁর ছোট্ট দোকানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই দোকানের সামনে এত দীর্ঘ লাইন হয়ে যেত যে, বাজারের সেই রাস্তার নামই নাকি পাল্টে হয়ে যায় লাইনবাজার।
লোকমুখে রামরতনের পেঁড়ারও একটি নাম হয়ে গিয়েছিল। সে সময় থেকেই তা ‘ধারওয়াড় পেঁড়া’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। স্থানীয়দের অনেকের কাছে তা অবশ্য ‘লাইনবাজার পেঁড়া’ নামে পরিচিত ছিল।
রামরতনের পেঁড়া খেতে লাইনবাজারের ছোট্ট দোকানে সাতসকালেই ভিড়ে জমে যেত। কথিত, সকাল ১০টায় দোকান খোলার পর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ‘ধারওয়াড় পেঁড়া’ ফুরিয়ে যেত। বিক্রিবাটা বৃদ্ধি করতে রামরতন নাকি নিয়ম করেছিলেন, ৫০০ গ্রামের বেশি পেঁড়া কিনতে পারবেন না এক জন ক্রেতা।
রামরতনের পর তাঁর নাতি বাবু সিংহ ঠাকুরের হাত ধরে এই পারিবারিক ব্যবসার প্রসার হয়েছিল। কয়েক দশক ধরে একটি দোকানই চালিয়েছিলেন বাবু সিংহ। তবে ধীরে ধীরে ধারওয়াড়, হুবলি, বেলগাম এবং হাবেরী শহরেও এই পেঁড়ার দোকান খোলেন তিনি।
দেশের নানা প্রান্তেই মিষ্টির দোকানে ‘ধারওয়াড় পেঁড়া’ পাওয়া যায়। তবে সেগুলি নাকি রামরতনের ‘আসল’ পেঁড়া নয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেঁড়া ছাড়াও নানা রকম মিষ্টি বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন রামরতনের নাতি।
১৭৫ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও রামরতনের পেঁড়ার রেসিপি নাকি আজও গোপন রয়েছে। এই পেঁড়া তৈরির জন্য আজও নাকি গ্যাস বা বৈদ্যুতিন যন্ত্রের বদলে কাঠের উনুনে দুধ জ্বাল দেওয়া হয়।
পেঁড়া তৈরির সময় উপকরণের যাবতীয় সামগ্রী নাকি নিজের হাতেই মেশান রামরতনের পরিবারের কোনও সদস্য। যাতে দোকানের কর্মীদের কেউ এই রেসিপি বেহাত না করে ফেলেন
২০০৭ সালে ‘জিআই’ (জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) স্বীকৃতি পেয়েছে ধারওয়া়ড় পেঁড়া। সংবাদমাধ্যমের দাবি, দিনে ৮০০ কেজির বেশি এই পেঁড়া বিক্রি হয়।
ব্যবসার খাতিরে নিজেদের একটি ওয়েবসাইটও খুলেছেন রামরতনের পরিবারের সদস্যরা। অনলাইনেও এই পেঁড়া বিক্রি করছেন তাঁরা। সেখানে বলা হয়েছে, ধারওয়াড় পেঁড়া বিক্রিতে জুড়ে গিয়েছেন রামরতনের পঞ্চম পুরুষ।