২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল, ৭ বছরে ৩০টি শিশুকে যৌন হেনস্থা এবং খুনের অভিযোগ উঠেছে দিল্লির বাসিন্দা রবীন্দ্র কুমারের বিরুদ্ধে। ‘শিকারের’ জন্য কখনও কখনও সে মাঝরাতে হাঁটা দিত ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। একটি খুন এবং শিশুকে যৌন নিপীড়ন মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া যুবকের কাণ্ড দেখে চমকে উঠেছেন তদন্তকারীরাও।
সম্প্রতি ৩১ বছরের যুবক রবীন্দ্র কুমারকে একটি ৬ বছরের শিশুকে যৌন হেনস্থা এবং খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। ২০১৫ সালে ওই মামলায় অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তদন্তে নেমে যে তথ্য পেয়েছে তারা, তাতে আসামির কড়া শাস্তির দাবি করেছেন তদন্তকারীরা। কেমন সেই অপরাধের প্রকৃতি?
শিশুকে যৌন হেনস্থা করে খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে অভিযুক্ত রবীন্দ্রের বিকৃত মানসিকতার শিকার হয়েছে অনেক শিশু। অভিযোগ, একটা-দুটো নয়, অন্তত ৩০টি শিশুকে যৌন হেনস্থার পর খুন করেছে ওই যুবক।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, রবীন্দ্র আদতে উত্তরপ্রদেশের কাসগঞ্জের বাসিন্দা। ২০০৮ সাল নাগাদ সে দিল্লিতে আসে কাজের খোঁজে। গরিব পরিবার। বাবা কলের মিস্ত্রির কাজ করতেন। মা বাড়ির কাজ করেন।
রাজধানীতে এসে রবীন্দ্র শ্রমিকের কাজ করত। থাকত একটা ঝুপড়িতে। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, ওই কাজ করতে করতেই ১৮ বছর বয়সি তরুণের ‘হাতেখড়ি’ হয় অপরাধমূলক কাজে।
সারা দিন কাজ করত রবীন্দ্র। সন্ধ্যায় ঝুপড়িতে ফিরত। তার পর রাতে সম্পূর্ণ ‘অন্য মানুষ’ সে। রাত গভীর হলে ঝুপড়ির বাইরে বেরোত রবীন্দ্র। শুরু করত নাবালকদের খোঁজ। তার পর ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ এবং নৃশংস ভাবে কচিকাঁচাদের খুন করত সে।
পুলিশ জানাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত তারা যে তথ্য পেয়েছে তাতে মনে করা হচ্ছে, রবীন্দ্র ৩০টি শিশুকে যৌন নিগ্রহ করে খুন করেছে। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সি নাবালক-নাবালিকা ছিল তার লক্ষ্য।
এমন বিকৃত যৌনাচার এবং খুনে সত্তা প্রকট হল কী ভাবে? দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর, একটি ঝুপড়িতে একাই থাকত রবীন্দ্র। দিনের বেলা বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকের কাজ করত। সন্ধ্যা হলে বাড়ি ফিরত টলোমলো পায়ে। গলা পর্যন্ত নেশা করে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ত। প্রতি দিনের এই ‘রুটিন’ বদলে গেল একটি ঘটনার পর।
তদন্তকারীদের রবীন্দ্র জানিয়েছে, ১৮ বছর বয়সে প্রথম নীল ছবি দেখে সে। একটি ভিডিও ক্যাসেট পেয়েছিল এক জনের কাছে। সেই থেকে অশ্লীল ছবির প্রতি তার আসক্তি তৈরি হয়। নিয়ম করে রোজই ওই ধরনের ছবি দেখত। সঙ্গে চলত মদ্যপান এবং ধূমপান।
পুলিশ জানাচ্ছে, রাত ৮টার মধ্যে নিজের ঘরে চলে আসত রবীন্দ্র। তখন নেশায় ডুবে সে। কিছু ক্ষণ ঘুমিয়ে নিত নিজের ঘরে। মাঝরাতে গোটা বস্তি যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন ঘর থেকে বার হত রবীন্দ্র।
রবীন্দ্র খুঁজত অল্পবয়সিদের। পথশিশুদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে কাছে ডাকত। কাউকে ১০ টাকার নোট দিয়ে, তো কাউকে চকোলেট-লজেন্সের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যেত নির্জন জায়গায়।
শিশুদের যৌন নির্যাতন করে নৃশংস ভাবে খুন করত রবীন্দ্র। এমনই দাবি তদন্তকারীদের। খুনের কারণ, অপরাধের কোনও প্রমাণ রাখতে চায়নি রবীন্দ্র। অভিযোগ, এই ভাবে ৩০টি শিশুকে যৌন নিগ্রহ এবং খুন করেছে সে।
প্রতি দিনই যে পথশিশুদের পেত এমন নয়। এক এক দিন হন্যে হয়ে ‘শিকারের’ খোঁজ করত রবীন্দ্র। মাঝরাতে বিভিন্ন বস্তি এলাকা ঘুরে বেড়াত সে। এমনকি রাতে বেরিয়ে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটেছে রবীন্দ্র। তার পর যৌন নির্যাতন, খুন এবং তার পর ধীরেসুস্থে ঘরে ফেরা!
কখনও কারও সন্দেহ হত না রবীন্দ্রকে। ২০১৪ সালে একটি শিশুকে অপহরণ, যৌন হেনস্থা এবং খুনের চেষ্টার ঘটনায় রবীন্দ্রকে সন্দেহ হয় পুলিশের। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ।
পুলিশ জানতে পারে শিশুটিকে যৌন নিগ্রহের পর খুন করে একটি সেপ্টিক ট্যাঙ্কে ফেলে দিয়েছিল রবীন্দ্র। ওই মামলার তদন্তে নেমে হতবাক হয়ে যান তদন্তকারীরাও। দিল্লির রোহিণী এলাকার বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে রবীন্দ্রকে চিহ্নিত করেন তদন্তকারীরা। জানা যায়, রবীন্দ্র ছোট মেয়েটিকে শারীরিক অত্যাচারের পর ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে দেয়। তার পর সেপ্টিক ট্যাঙ্কে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়।
দীর্ঘ দিন ওই মামলার তদন্ত চলে। রবীন্দ্রকে জেরা করতে গিয়ে যে বর্ণনা পান তদন্তকারীরা, তাতে চমকে যান তাঁরা। পুলিশ জানাচ্ছে, যখন অপরাধের বর্ণনা দিত, রবীন্দ্রের মধ্যে কোনও লুকোছাপা থাকত না। কোনও খেদ নেই। জড়তা নেই। গড়গড় করে নিজের কাণ্ডকারখানার কথা পুলিশকে শুনিয়েছে সে। জানিয়েছে কী ভাবে মাইল পর মাইল রাস্তা হেঁটেছে ধর্ষণ এবং খুন করবে বলে।
পুলিশ জানাচ্ছে, প্রথম প্রথম শিশুদের যৌন হেনস্থা করে পালাত রবীন্দ্র। খুন বা মারধর করত না। কিন্তু একটি খুনের ঘটনার পর পুলিশের নজরে পড়ে যায় সে। তাই, তার পর বেশির ভাগ ‘শিকার’কে খুন করে ফেলত। ভাবত, বেঁচে গেলে যদি পুলিশের হাতে আরও একটা প্রমাণ চলে যায়! তাই মেরে ফেলাই শ্রেয়। এটা এক রকম রুটিন করে ফেলে রবীন্দ্র। শিশুদের যৌন নিগ্রহ এবং খুন— এই ছিল রবীন্দ্রের নেশা।
রবীন্দ্রের নিজের মুখে পুলিশ যত তার অপরাধের স্বীকারোক্তি শুনত তত বিস্মিত হত। কারণ রবীন্দ্র যেন গল্পের ছলে সব বলত। ২০১৫ সালে দিল্লির তৎকালীন ডিসিপি বিক্রমজিৎ সিংহ রবীন্দ্রকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি অপরাধের ঘটনার বিবরণ পুঙ্খনাপুঙ্খ ভাবে দিত রবীন্দ্র। এটা আমাদের অদ্ভুত লাগত।’’
এখন একটি মাত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছে রবীন্দ্র। তদন্তকারীরা চান এমন নৃশংস এবং নীচ দোষীর কঠোর শাস্তি হোক।