জয়াপ্রদা। সত্তরের দশকে বলিজগতে পথচলা শুরু করে আশির দশকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছন তিনি। তেলুগু, তামিল, হিন্দি, কন্নড়, মালয়ালম, মরাঠি থেকে বাংলা ছবিতে অভিনয় করে নিজের কেরিয়ার গড়েছেন জয়া। এক সময় শ্রীদেবীর মতো তারকাকে টক্কর দিতেন তিনি। অভিনেত্রীর কর্মজীবন যতটা আলোর রোশনাইয়ে ভরপুর ছিল, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল ততটাই কণ্টকময়।।
১৯৬২ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে জন্ম জয়াপ্রদার। ছোটবেলা থেকে নাচ, গান এবং অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। কিশোরী বয়সে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নাচ করেছিলেন তিনি। দর্শকের আসনে বসেছিলেন দক্ষিণী ফিল্মজগতের এক পরিচালক। জয়ার নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ভূমি কোসম’ নামের একটি তেলুগু ছবিতে ৩ মিনিট দৈর্ঘ্যের একটি নাচের দৃশ্যে জয়া অভিনয় করার সুযোগ পান। এই নাচের পর দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির নজরে প়ড়েন জয়া। একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে জয়ার কাছে।
কম বয়সেই দক্ষিণী ফিল্মজগতে নিজের পরিচয় তৈরি করে ফেলেছিলেন জয়া। কমল হাসন, রজনীকান্ত, শত্রুঘ্ন সিন্হা, জীতেন্দ্র, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খন্নার মতো তারকার সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। কানাঘুষো শোনা যায়, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত অনেকেই নাকি জয়াকে বিয়ে করতে চাইতেন। কিন্তু জয়া তখন প্রযোজক শ্রীকান্ত নাহাতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন।
নাহাতার প্রতি জয়ার এই প্রেমের নেপথ্যে ছিল অন্য এক কারণ। এক বার আয়কর সংক্রান্ত গুরুতর সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিলেন জয়া। সেই সময় কোনও তারকা তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াননি। কিন্তু শ্রীকান্ত সব সময় জয়ার পাশে ছিলেন। জয়ার মনে হল, যে মানুষটি তাঁর জীবনের এত বড় সমস্যায় পাশে ছিলেন, সেই মানুষটিই তাঁর জীবনসঙ্গী হওয়ার যোগ্য।
শ্রীকান্তের সঙ্গে জয়ার মেলামেশা বাড়তে থাকে। সম্পর্ক ধীরে ধীরে প্রণয়ে পরিণত হয়। কিন্তু শ্রীকান্ত বিবাহিত ছিলেন। দুই সন্তানও ছিল তাঁর। জয়া সব জেনেই শ্রীকান্তের প্রেমে পড়েছিলেন। দু’জনে একসঙ্গে থাকতেও শুরু করেন।
শ্রীকান্তকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন জয়া। তবে, শ্রীকান্ত জানিয়ে দেন যে জয়াকে বিয়ে করলেও তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারবেন না। শ্রীকান্তের শর্তে রাজি হয়ে যান জয়া।
১৯৮৬ সালে শ্রীকান্ত এবং জয়া বিয়ে করেন। বিয়ের খবর জনসমক্ষে আসা মাত্রই জয়া বলিপাড়ায় কটাক্ষের শিকার হন। শ্রীকান্তকে বিয়ে করা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন জয়া।
বিয়ের পর শ্রীকান্তকে জয়া জানান যে তিনি মা হতে চান।শ্রীকান্ত কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেন। এই সময়ে তাঁর প্রথম স্ত্রীর গর্ভে তৃতীয় সন্তান জন্ম নেয়। এই ঘটনাগুলি নিয়ে চর্চা শুরু হয়।
জয়াকে কোনও দিনই নিজের বাড়িতে নিয়ে যাননি শ্রীকান্ত। আলাদা একটি বাড়িতে থাকতেন অভিনেত্রী। শ্রীকান্ত মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। বেশির ভাগ সময় শ্রীকান্ত তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং তিন সন্তানের সঙ্গে কাটাতেন।
শ্রীকান্তের সঙ্গে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে জয়ার। আইনগত ভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও শ্রীকান্তের থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন জয়া। পরে জয়া এক পুত্রসন্তান দত্তক নেন।
কেরিয়ারের তুঙ্গে থাকাকালীনই রুপোলি পর্দা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন জয়া। ১৯৯৪ সালে তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-তে যোগ দেন ৩২ বছরের জয়া। ২০১৮ সালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এনটিআর (এন টি রামা রাও)-এর একটা ফোনে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম। ছোটবেলা থেকে ওঁর ছবি দেখে বড় হয়েছি। হঠাৎ এক দিন ওঁর নায়িকা হলাম। রাজনীতিতে আসাটাও হঠাৎ করেই হয়েছিল।’’
হঠাৎ করে চলে এলেও রাজনীতিতে কম সফল হননি বলিউডের এই নায়িকা। ১৯৯৬ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হন। তবে এন চন্দ্রবাবু নায়ডু টিডিপি-র দায়িত্ব নেওয়ার পর দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরে।
এর পর মুলায়ম সিংহ যাদবের ডাকে সাড়া দিয়ে সমাজবাদী পার্টিতে চলে যান জয়া। যদিও ২০১০ সালে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাঁকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন মুলায়ম। তার আগেই অবশ্য রামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে দু’বার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি (২০০৪ এবং ২০০৯)।
২০১১ সালে অমর সিংহের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় লোকমঞ্চ (আরএলএম) গঠন করেন জয়া। তবে তাতেও বেশি দিন ছিলেন না। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় লোকদল (আরএলডি)-এর সদস্য হন। তবে ওই দলের টিকিটে বিজনৌর লোকসভা কেন্দ্র থেকে পরাজিত হওয়ার পর আবারও দলবদল করেন।
এ বার বিজেপি। ২০১৯ সালে গেরুয়া শিবিরের টিকিটে সেই রামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে দাঁড়ালেও সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী আজ়ম খানের কাছে পরাজিত হন জয়া।রাজনীতিতে যোগ দিলেও সিনেমার পর্দাকে পুরোপুরি বিদায় জানাননি। নব্বইয়ের দশক থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সিনেমায় কাজ করে গিয়েছেন জয়াপ্রদা।