ভারতীয় রাজনীতি এবং খেলাধুলোর বৃত্তে তিনি এখন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। অভিযোগ, এক নাবালিকা-সহ বেশ কয়েক জন মহিলা কুস্তিগিরকে হেনস্থা করেছেন তিনি। আর তা নিয়ে সরব হয়েছেন বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগটের মতো দেশের তাবড় কুস্তিগিরেরা। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ। ভারতীয় কুস্তি সংস্থার বর্তমান সভাপতি। একই সঙ্গে বিজেপি নেতা তথা লোকসভার সাংসদ।
তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক বিতর্কে জড়িয়েছে ব্রিজভূষণের নাম। তাঁর ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক—উভয় জীবনই বিতর্ক এবং অভিযোগে জর্জরিত।
১৯৫৭ সালের ৮ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোন্দায় এক রাজপুত পরিবারে জন্ম ব্রিজভূষণের। তাঁর বাবার নাম জগদম্বা শরণ সিংহ এবং মায়ের নাম পেয়ারি দেবী সিংহ।
অযোধ্যার সাকেত পিজি কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮১ সালে কেতকি দেবী সিংহকে বিয়ে করেন ব্রিজভূষণ। তাঁর তিন ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছে। ২০০৪ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রিজভূষণের বড় ছেলে শক্তি শরণ সিংহ আত্মহত্যা করেন।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিস্তল দিয়ে নিজের মাথায় গুলি চালিয়েছিলেন শক্তি। আত্মহত্যার আগে একটি সুইসাইড নোটও তিনি লিখে যান। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, বাবা ব্রিজভূষণের স্বার্থন্বেষী মনোভাবের জন্যই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
ব্রিজভূষণ বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের কায়সারগঞ্জের বিজেপি সাংসদ। তিনি মোট ছ’বারের সাংসদ। যার মধ্যে পাঁচ বার বিজেপির আসনে এবং এক বার সমাজবাদী পার্টির আসনে জিতেছেন তিনি।
১৯৯১ সালে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে উত্তরপ্রদেশের গোন্দা লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদ হন ব্রিজভূষণ। ১৯৯৯ সালে ওই একই নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে আবার বিজেপির সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে বিজেপির টিকিটে সাংসদ হন বলরামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে।
২০০৮ সালের ২০ জুলাই লোকসভায় আস্থা ভোটের সময় দলের নির্দেশ অমান্য করে অন্য দলে ভোট দেওয়ার অভিযোগে ব্রিজভূষণকে বহিষ্কার করে বিজেপি। এর পর তিনি সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন। ২০০৯ সালে, তিনি উত্তরপ্রদেশের কায়সারগঞ্জ থেকে আবার সাংসদ নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল আসনে জয়ী হয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করে বিজেপি। আর তার কয়েক মাসের মধ্যে ব্রিজভূষণ আবার বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কায়সারগঞ্জ থেকে জিতেই তিনি আবার লোকসভার সাংসদ হন।
পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৭৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে মোট ৩৮টি ফৌজদারি মামলা রুজু করা হয়েছে। যার মধ্যে চুরি, ডাকাতি, খুন, খুনের চেষ্টা এবং অপহরণ-সহ বহু অভযোগ রয়েছে। যদিও ব্রিজভূষণের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, তাঁকে বেশির ভাগ মামলায় বেকসুর খালাস করা হয়েছে।
বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে ধৃতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রিজভূষণ। কুখ্যাত গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী ‘টাডা’ আইনেও মামলা রুজু করা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তবে দু’ক্ষেত্রেই প্রমাণের অভাবে তিনি খালাস পেয়ে যান।
২০২২ সালে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য লল্লনটপ’-এর সঙ্গে একটি ভিডিয়ো সাক্ষাত্কারে ব্রিজভূষণ বলেন, ‘‘আমি অতীতে একটি খুন করেছি। লোকে যাই বলুক না কেন, আমি খুন করেছি। যে আমার প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্র সিংহকে গুলি করেছিল তাকে আমি গুলি করে খুন করেছি।’’
মহিলা কুস্তিগিরদের উপর যৌন নিগ্রহের অভিযোগের আগে ভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি হিসাবে অন্য বিতর্কেও জড়িয়েছেন ব্রিজভূষণ। এক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সময় তিনি বলেন, ‘‘কুস্তিগিরেরা শক্তিশালী ছেলে-মেয়ে। ওদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরও শক্তিশালী কাউকে দরকার। আমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী কেউ আছে নাকি এখানে?’’
২০২১ সালে একটি কুস্তি প্রতিযোগিতা চলাকালীন ব্রিজভূষণ মঞ্চে উঠে এক কুস্তিগিরকে চড় মারেন। সেই দৃশ্য ক্যামেরায় ধরাও পড়েছিল। তার পর আসে প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরদের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ।
ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে তিনি অনেক মহিলা কুস্তিগিরকে যৌন নিগ্রহ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে এক জন অপ্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরও।
অভিযোগ, ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের ছবি তোলার নাম করে তাঁর শরীর ছুঁয়েছেন ব্রিজভূষণ। তাঁর কাঁধে-বুকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হাত দিয়েছেন। অভিযোগ, শারীরিক সম্পর্কে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বার বার উত্ত্যক্ত করেছেন ভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি।
মহিলা কুস্তিগিরের আরও অভিযোগ রয়েছে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে। কারও অভিযোগ, রেস্তরাঁয় খেতে নিয়ে গিয়ে তাঁর শ্লীলতাহানি করেছেন ব্রিজভূষণ। আবার কারও অভিযোগ, নিশ্বাস-প্রশ্বাস দেখার নাম করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে হাত দেন ব্রিজভূষণ।
এই সব অভিযোগ নিয়ে বিগত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তাল হয়েছিল রাজধানী দিল্লির রাস্তা। ২৩ এপ্রিল থেকে যন্তর মন্তরে ধর্না চালাচ্ছিলেন বজরং, সাক্ষী, বিনেশরা। দিল্লি পুলিশের হস্তক্ষেপে অবশেষে ২৮ মে সেখান থেকে উঠতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে ব্রিজভূষণকে। সরাতে হবে ভারতীয় কুস্তি সংস্থার মাথা থেকে। তবে এই নিয়ে এখনও কোনও সুরাহা হয়নি। উল্টে ধর্নায় বসে পুলিশের হাতে আটক হতে হয় সাক্ষীদের।
২৮ এপ্রিল দিল্লি পুলিশের কাছে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিজভূষণ মেয়েদের নিগ্রহ করেছেন। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে ৩৫৪, ৩৫৪এ এবং ৩৪ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। একটি এফআইআরে বলা হয়েছে ছ’জন প্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের কথা। দ্বিতীয়টিতে এক অপ্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের বাবা অভিযোগ করেছেন ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে।
যদিও দিল্লি পুলিশের দাবি, কুস্তি ফেডারেশনের কর্তা ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ নেই। তাই তাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। সাক্ষী মালিকেরা এ বার দু’টি এফআইআরে মোট ১০টি নিগ্রহের ঘটনার উল্লেখ করেছেন।