জল্পনা ছিল অনেক। সে সব জল্পনায় জল ঢেলেই রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করল বিজেপির পর্যবেক্ষক দল। সে রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল শর্মা। কে এই ভজনলাল, যিনি রাজস্থান বিজেপির হেভিওয়েট নেতাদের পিছনে ফেলে দিলেন?
এই প্রথম বার বিধায়ক হয়েছেন ভজন। বিজেপির টিকিটে সঙ্গনেড় থেকে জিতেছেন তিনি। প্রথম বার বিধায়ক হয়েই মুখ্যমন্ত্রী। প্রায় অপরিচিত মুখ ভজনকে কেন মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য বেছে নিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব? সূত্রের খবর, তাঁর নাম প্রস্তাব করেছেন খোদ বসুন্ধরা রাজে।
ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান— তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়েছে বিজেপি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা নিয়ে শুরু হয় গোল। শেষ পর্যন্ত তিন রাজ্যে পর্যবেক্ষক দল নিয়োগ করেন শীর্ষ নেতৃত্ব। তারাই স্থির করে মুখ্যমন্ত্রীর নাম।
ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম ইতিমধ্যে ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে জয়পুরে পৌঁছয় বিজেপির পর্যবেক্ষক দলের তিন সদস্য বিনোদ তাওড়ে, সরোজ পাণ্ডে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী। মাথায় ছিলেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলকে স্বাগত জানান রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে এবং সিপি জোশী। তখনও বসুন্ধরা হয়তো আন্দাজ করতে পারেননি যে, কী হতে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার ছিলেন ঢোলপুরের মহারানি। দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরাকে সরিয়ে যে প্রথম বারের বিধায়ক ভজনকে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে, রাজনীতিকদের বড় অংশও আন্দাজ করতে পারেননি।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে বসুন্ধরার পাশাপাশি এগিয়ে ছিলেন জয়পুরের রাজকুমারী দীয়া কুমারী, বিজেপি সাংসদ বালকনাথ, কিরোরিলাল মিনা। শেষ পর্যন্ত দিয়াকে রাজস্থানের উপমুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছে বিজেপি। আর এক উপমুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন প্রেমচাঁদ বৈরওয়া।
কিন্তু কী ভাবে সকলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এলেন ভজন? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, এ ক্ষেত্রে সম্ভবত আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কথাই মাথায় রেখেছে বিজেপি। আর সে কারণেই ব্রাহ্মণ নেতা ভজনকে করা হয়েছে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে গোবলয়ের রাজ্যগুলিতে জাতপাতের সমীকরণ বড় ভূমিকা নিতে পারে। রাজনীতিকদের একাংশ মনে করছেন, সে কারণে ছত্তীসগঢ়ে আদিবাসী নেতা বিষ্ণুদেও সাই, মধ্যপ্রদেশে অনগ্রসর (ওবিসি) নেতা মোহন যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী করার পর রাজস্থানে অগ্রাধিকার দেওয়া ব্রাহ্মণ নেতা ভজনকে। এতে বিজেপি ব্রাহ্মণ ভোটব্যাঙ্ক অনেকটাই সুরক্ষিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিজেপির একাংশ মনে করে, রাজস্থানে এক জন ব্রাহ্মণ নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী করলে তা কখনওই অন্তত দলকে বিপাকে ফেলবে না। রাজস্থানে জাঠ আর রাজপুত ভোটারদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে মুখ্যমন্ত্রী করলে অন্য সম্প্রদায় চটে যেতে পারে। তার প্রভাব পড়তে পারে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে।
এ ক্ষেত্রে বসুন্ধরাকে মুখ্যমন্ত্রী করলে একটা সুবিধা পেতে পারত বিজেপি। তিনি জন্মসূত্রে রাজপুত। বিয়ে হয়েছে জাঠ বংশে। তাই দুই সম্প্রদায়ের কাছেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। কিন্তু বিজেপি সেই পথে হাঁটতে চায়নি।
রাজস্থান বিজেপির নেতাদের একাংশ আবার মনে করেন, আসলে বসুন্ধরার ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করতে চাইছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। অনেক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন তিনি। তাই হয়তো তাঁর ডানা ছাঁটার উদ্দেশ্যেই ভজনকে এগিয়ে দিয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। বিজেপি সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য ভজনের নাম পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রস্তাব করেছেন বসুন্ধরাই।
এমনিতে শিরোনামে থাকতে চাননি কখনও। তবে বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর সঙ্গে ভজনের যোগসূত্র দীর্ঘ দিনের। তাতে তিনি টেক্কা দিতে পারেন অনেক শীর্ষনেতাকেই। ৫৬ বছরের ভজনের রাজনীতিতে প্রবেশ আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির হাত ধরে।
বিধায়ক হয়েছেন প্রথম বার। তবে ভজন বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন চার বার। বরাবরই সংগঠনের দিকটি সামলেছেন। সেই এবিভিপিতে থাকার সময় থেকেই। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তাঁর।
২০২৩ বিধানসভা নির্বাচনে সঙ্গনেড় কেন্দ্রে সেখানকার প্রাক্তন বিধায়কের পরিবর্তে টিকিট দেওয়া হয় ভজনকে। অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত ওই আসনে লড়ে ৪৮ হাজার ভোটে জিতেছেন তিনি। হারিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী পুষ্পেন্দ্র ভরদ্বাজকে।
বিজেপির অন্দরে কানাঘুষো, ভজনকে বড় পদের জন্য নেতৃত্ব ভাবছিলেন বলেই সঙ্গনেড়ের মতো কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়েছে, যেখানে ভোটজয় ছিল সহজ। ভজন আদতে ভরতপুরের বাসিন্দা হলেও সেখানে তাঁকে প্রার্থী করা হয়নি। কারণ ওই আসনে বিজেপি প্রার্থীর জয় খুব একটা সহজ ছিল না।
তাঁর নাম মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য ঘোষণা হওয়ার পরেই ভজন জানান, তাঁর সরকার রাজস্থানবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবে। তিনি বলেন, ‘‘মানুষের যে প্রত্যাশা রয়েছে আমাদের থেকে, তা পূরণ করবেন রাজস্থানের বিধায়কেরা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আমরা রাজস্থানের উন্নয়ন ঘটাব।’’
ভজন এখন থাকেন জয়পুরের জওহর সার্কলে। ভোটের আগে মনোনয়ন পেশের সময় যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন তিনি, তাতে দেখা গিয়েছে, ভজন স্নাতকোত্তর।
হলফনামা অনুযায়ী, ভজনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১.৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৪৩.৬ লক্ষ টাকা। স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ এক কোটি টাকা।
রাজস্থানে মোট বিধানসভা আসন ২০০। তার মধ্যে ১৯৯টি আসনে ভোট হয়েছে। বিজেপি জিতেছে ১১৫টি আসনে। কংগ্রেস ৬৯টি আসনে। নাম ঘোষণার পর রাজস্থানের রাজ্যপাল কলরাজ মিশ্রের সঙ্গে ইতিমধ্যেই দেখা করে সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ভজন।