Dilip Ghosh

দিলীপ ও ‘মেসো’পটেমিয়া, রাজনীতিতে নতুন ‘সভ্যতা’ এনেছেন বিজেপি নেতা

বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদ যাওয়ার পর থেকে ‘দিলীপ-বাণী’তে কিঞ্চিৎ টান পড়েছিল। তবে চলতি লোকসভা ভোটে মেদিনীপুরের বিদায়ী সাংসদ বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকে প্রার্থী হতেই ‘দিলীপ-দর্প’ চলছেই।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৪ ১২:১৮
Share:
০১ ২১

বাংলার রাজনীতিতে তিনি ‘প্রকট’ হওয়ার পর থেকে ভাষাই তাঁর প্রধান হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার নিয়ে বিতর্ক বিস্তর। কিন্তু দিলীপ ঘোষের অগাধ আস্থা তাঁর ‘বাক্শক্তি’তে। শাসককে নিশানা করতে গিয়ে এমন এমন শব্দ প্রয়োগ করেছেন, যা নজিরবিহীন। কখনও তিনি ‘বিদেশি গরুকে’ ‘মাসি’ বলেন, কমিশনকে ডাকেন ‘মেসো’ বলে। কখনও মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে এমন মন্তব্য করেন, যে অস্বস্তিতে পড়ে দলই। তাতে দিলীপের অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই। দিলীপ আছেন দিলীপেই। বাংলার রাজনীতিতে ‘ভাষা সংস্কৃতিতে’ তিনি সাক্ষাৎ এক সভ্যতা। ‘মেসো’পটেমিয়া সভ্যতা।

০২ ২১

বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদ যাওয়ার পর থেকে ‘দিলীপ-বাণী’তে কিঞ্চিৎ টান পড়েছিল। তবে চলতি লোকসভা ভোটে মেদিনীপুরের বিদায়ী সাংসদ বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকে প্রার্থী হতেই ‘দিলীপ-দর্প’ চলছেই। এ বারের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে গুচ্ছ আক্রমণ এবং কটাক্ষের মধ্যে দিলীপ ভোটের বাজার সবচেয়ে বেশি ‘গরম’ করলেন অনেকগুলো মন্তব্য দিয়ে। নির্বাচন কমিশনের শো-কজ়, দলের নির্দেশিকা, কোনও কিছুই দিলীপের মুখের আগল ধরে রাখতে পারেনি এ বারও।

Advertisement
০৩ ২১

গত এপ্রিলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সপার্ষদ গিয়েছিলেন রাজভবনে। তৃণমূলের দাবি ছিল, রাজধানী দিল্লিতে তাদের প্রতিনিধি দলকে যে ভাবে দিল্লি পুলিশ ‘হেনস্থা’ করেছে, তারই প্রতিবাদ জানাতে রাজভবন অভিযান। রুটিন ‘প্রভাতী বচনে’ তার সমালোচনা করেন বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভার কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী। দিলীপ বলেন, ‘‘যাদের বেশি গালাগালি দিত তৃণমূল, সমালোচনা করত, এমন পরিস্থিতি যে, তাদের পায়ে গিয়ে পড়তে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নাকি বিজেপির দালাল! সকাল-বিকেল রাজ্যপালের অফিসে গিয়ে পড়ে থাকছে।’’ তার পরেই তিনি বলেন, ‘‘কী এমন পরিস্থিতি হয়ে গেল? প্যাঁচে পড়লে ‘কাকা বাঁচাও’, ‘মেসো বাঁচাও’! এজেন্সি ঠিক কাজ করছে।’’ বৈঠকি মেজাজে দিলীপ বলেন, ‘‘ওয়াক্ত পড়ে বাঁকা, তো গাধা কো কহে কাকা!’’ (গোলমেলে সময়ে গাধাকেও কাকা ডাকার মতো ভুল হয়ে যায়।) ফল, বিতর্ক।

০৪ ২১

দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে তৃণমূল ’৮৩-র বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের সদস্য কীর্তি আজ়াদকে প্রার্থী করার পরে যুযুধান দুই পক্ষের বাগ্‌যুদ্ধে ক্রমাগত গরম হয়েছে বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্র। পুজো দিতে গিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়েননি বিজেপি প্রার্থী। প্রচারে যাওয়ার আগে কালীমন্দিরে গিয়েছিলেন পুজো দিতে। সেখানেও তৈরি করলেন বিতর্ক। কারণ, পুরোহিতকে ডেকে দিলীপ বললেন, ‘‘মাকে বলুন যাতে বর্ধমান-দুর্গাপুরের সম্মান রাখতে পারি। বহিরাগতরা যেন জামাকাপড় খুলে রেখে চলে যায়।’’ তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে তৃণমূল। শাসকদলের নেতাদের অভিযোগ, ভাষা-সন্ত্রাস করছেন তিনি।

০৫ ২১

পুলিশকে আক্রমণ দিলীপের কীর্তিতে নতুন কিছু নয়। সেই ‘রেকর্ড’ এ বারও ধরে রেখেছেন। পুলিশকে মারধর, বিবস্ত্র করার নিদান দেওয়ার পর এ বার রাতে থানা ‘জ্যাম’ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন দিলীপ। পর ক্ষণেই অবশ্য পায়রা উড়িয়ে শান্তির বার্তা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এক জন পায়রা নিয়ে এসেছিল। ওড়ালাম। টিএমসি-র লোকেদের বুঝিয়ে দিলাম, শান্তিতে ভোট করো। যারা বোঝার বুঝে গিয়েছে।’’ পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ যদি বেশি প্রভুভক্তি দেখায়, তা হলে শুধু মুখে বলব না, থানা জ্যাম করে দেব গোটা রাত। ওরা ওদের কাজ করবে। আমরা আমাদের কাজ করব। কিন্তু ওরা যদি রাজনীতি করতে আসে, তা হলে ওদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করব।’’

০৬ ২১

লোকসভা ভোটে নির্বাচন কমিশনের শো-কজ় ‘খেয়েছেন’। কিন্তু টলেননি দিলীপ। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে পাল্টা কটাক্ষ শুনেছেন দিলীপ। বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীর মন্তব্য, ‘‘বাংলা খাও, জয় বাংলা বলো আর বিরোধীদের ঝান্ডা খোলো— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের এটাই কালচার।’’ এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতই চা-চক্র থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতার উদ্দেশে দিলীপ বলেন, ‘‘ওঁর ভাষাই তো আমরা মুখস্থ করেছি। উনিই তো আমাদের ‘টিচার’। কী করে ভদ্রলোকেদের অপমান করতে হয়, কী করে বড় নেতাদের নাম নিয়ে বড় নেতাদের অপমান করতে হয়, উনিই শিখিয়েছেন!’’ দিলীপ আরও বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে বদনাম করেছেন উনি। বাঙালিকে বদনাম করেছেন। বিরোধীদের কী ভাবে ‘কেস’ দিতে হয়, শায়েস্তা করতে হয়, উনিই শিখিয়েছেন। এ নিয়ে দলের নেতাদের উনি ‘ট্রেনিং’ দিয়েছেন।’’

০৭ ২১

দিলীপ ঘোষের গলায় এ বারও এসেছে গরুর কথা। তবে এ বার দুধ বা সোনা নিয়ে কোনও মন্তব্য নয়। দলীয় কর্মীদের একাংশকেই গরু চরানোর ‘পরামর্শ’ দেন বিজেপি নেতা। বার বার এক জায়গায় কর্মসূচি করার জন্য কর্মীদের প্রকাশ্যেই বকুনি দেন বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ। কেন কর্মীরা দলীয় কর্মসূচি ঠিক করে পালন করছেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘‘রাজনীতি ঠিক করে করতে না পারলে গরু চরাও গে যাও।’’

০৮ ২১

এ বার সিপিএমকে আক্রমণ করে তাদেরই ভোটপ্রার্থনা করেছেন দিলীপ ঘোষ। বাংলার কুর্সিতে তৃণমূলের থাকার কারণ হিসাবে সিপিএমকে দুষে দিলীপের মন্তব্য, ‘‘আপনাদের অপকর্মের জন্য আজ তৃণমূল এখানে রাজত্ব করছে। এই ডাকাতগুলোকে আমি দোষ দিইনি, আপনারা হাত ধরে বসিয়েছেন। আপনাদের দায়িত্ব আছে এদের তাড়াবার। তাই আমি বলছি, রং পরে দেখব, আগে এই ডাকাতগুলোকে সরাতে হবে।’’ তার পরেই দিলীপের ডাক, ‘‘আসুন, মোদীর হাত শক্ত করুন। আগে এদের সরিয়ে দেব, তার পর ঝান্ডার রং দেখব। বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোটে আপনি আপনার ঝান্ডা নিয়ে নির্বাচন লড়ুন। আগে বাংলাকে ডাকাত, চোরমুক্ত করুন। গত বার ভোটে ২২ শতাংশ বাম ভোটার আমাদের দিকে এসেছিলেন। তাই আমরা বিধায়ক, সাংসদ জিতেছি।’’

০৯ ২১

শুধু ঝাঁঝালো কথা নয়, এ বার প্রচারেও অভিনবত্ব দেখিয়েছেন দিলীপ। হাঁসফাঁস করা গরম বর্ধমান-দুর্গাপুর। দিলীপের দাবি, তিনি জনতার ‘পাল্‌স’ বোঝেন। এই গরমে নেতাদের গরমাগরম বক্তব্য শোনার ধৈর্য নেই কারও। কিন্তু ভোটের প্রচার তো বন্ধ থাকবে না। অমনি দিলীপ তাঁর রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ে বসলেন হাতপাখা নিয়ে। বিজেপির সেই কর্মসূচি থেকে ডাকও এল, হকাররা খরিদ্দারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যেমন করেন। ঘামতে ঘামতে হাতে প্লাস্টিকের হাতপাখা নাড়তে নাড়তে দিলীপ হাতপাখা বিলিয়েছেন জনতাকে। পাখা হাতে নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘টিএমসির হাওয়া ‘লু’। ও গরম হাওয়া খাবেন না। পদ্মফুলের গন্ধযুক্ত আমাদের পাখার মিষ্টি হাওয়া খান।’’ এমন প্রচার নিয়ে বিজেপি প্রার্থীর ‘বিজ্ঞ-জবাব, ‘‘প্রচারে নতুনত্ব আনতে হবে তো। চায়ের কাগজের কাপে, গেঞ্জি এবং টুপির মাধ্যমেও প্রচার করা যায়। মানুষের প্রয়োজন আমরা বুঝি। চা খেতে হবে। চা চক্রে বসলে কাপেও তাই ছবি (বিজেপির প্রতীক এবং ভোট দেওয়ার প্রার্থনা) দেওয়া থাকে।’’

১০ ২১

মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হামেশা আক্রমণ করেন দিলীপ ঘোষ। কিন্তু এ বার তাঁর এবং বিজেপির অন্যান্য নেতার আক্রমণের ‘মূল লক্ষ্য’ ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল প্রার্থী তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার সন্তর্পণে অভিষেক এবং মমতাকে নিয়ে মন্তব্য করে, তৃণমূলের মধ্যে বিভাজন রয়েছে , বোঝাতে চেয়েছেন দিলীপ। তাঁর কথায়, ‘‘আজ মুখ্যমন্ত্রীকে চোর-চোর শুনতে হচ্ছে ওঁর (অভিষেকের) জন্য।’’ অভিষেককে নির্বাচনী সভা থেকে বিজেপিকে দু’নম্বরি বলার পরিপ্রেক্ষিতে দিলীপের কটাক্ষ, ‘‘উনি একমাত্র ভদ্রলোক? যাঁর বাড়ির বৌ থেকে চাকর-বাকর, কুকুর— সবাইকে ইডি ডাকছে। সোনা নিয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় চোর-চোর বলে সবাই ডাকছে! ওঁর চোদ্দোপুরুষ চোর!’’

১১ ২১

পুলিশকে ‘চমকানোর’ বার্তা জারি রেখেছেন দিলীপ। বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের নানা জায়গায় গত কয়েক দিন ধরে তৃণমূল তাদের দেওয়াল মুছে দিচ্ছে, কোথাও পতাকা ছিঁড়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করছে বিজেপি। কার্জন গেটে পতাকা লাগানো নিয়ে দু’দলের হাতাহাতিও হয়। দু’পক্ষই পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। বর্ধমান মেডিক্যালে দু’জন ভর্তিও হন। ওই ঘটনা প্রসঙ্গে দিলীপের বার্তা, “থানা-পুলিশ করো। থানায় গিয়ে চিৎকার করতে হবে। চাপে রাখতে হবে পুলিশকে। ১০টা ছেলে গিয়ে থানায় চিৎকার করবে। হয় ওদেরকে (তৃণমূল) চমকাও, না হলে থানাকে চমকাও।”

১২ ২১

কখনও ডান্ডা, কখনও ত্রিশূল, কখনও হকিস্টিক নিয়ে তো কখনও ফুটবল খেলে তৃণমূলের উদ্দেশে ‘খেলা হবে’ বার্তা দিয়ে রেখেছেন দিলীপ ঘোষ। ইছলাবাদ ইয়ুথ ক্লাবের মাঠে দিলীপের হাতে হকিস্টিক তুলে দিয়েছিলেন শ্যামল রায়। যে শ্যামলকে কিছু দিন আগে বিজেপি বহিষ্কার করেছে, তাঁর হাত খেকে হকিস্টিক নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে বসে দিলীপের সাফাই ছিল, ‘‘এটা পার্টির কর্মসূচি নয়। এটা দিলীপ ঘোষের কর্মসূচি। এখানে কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল সবাই আছে। এখানে সমাজের সব ধরনের মানুষ আছেন। এটা জেলা সভাপতি বা রাজ্য সভাপতির ব্যাপার নয়, এটা দিলীপ ঘোষের নিজস্ব প্রোগ্রাম। দিলীপ ঘোষের ব্র্যান্ড চা-চক্র।’’ আবার এক দিন প্রচারে বেরিয়ে জানিয়ে দিলেন ডান্ডা কিন্তু তাঁর গাড়িতেই থাকে। দরকার পড়লে বার করবেন। বিতর্ক শুরু হতে দেরি হয়নি। দিলীপের তাতে থোড়াই কেয়ার।

১৩ ২১

সব সময় তৃণমূলকে চমকানো নয়, ‘পাশে’ দাঁড়াতেও দেখা গিয়েছে দিলীপকে। যা খানিকটা ‘অ-দিলীপসুলভ’। কিন্তু ওই যে অভিনবত্ব। আহত এক তৃণমূল কর্মীকে দেখতে সটান বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চলে গিয়েছিলেন বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ। সেখানে ভর্তি থাকা স্বপন মল্লিক নামে তৃণমূল কর্মীকে দেখে দিলীপ জানিয়ে দেন তাঁর পাশে বিজেপি আছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, গত ১০ এপ্রিল পূর্ব বর্ধমানের গলসিতে ওই তৃণমূল কর্মী জখম হয়েছিলেন। তাঁকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পুরসা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখান থেকে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরিবারের দাবি, ইদের উপহার দিতে স্ত্রী রূপা মল্লিক এবং এক নাতনিকে নিয়ে মেয়ের বাড়ি শিড়রাই গ্রামে গিয়েছিলেন স্বপন। শিড়ারাই আর পোতনার মাঝামাঝি জায়গায় তাঁর উপরে হামলা হয়। বাইক আটকে স্বপনকে লাঠি এবং টাঙ্গি দিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সেই স্বপনকে দেখে হাসপাতাল থেকে বেরোচ্ছেন দিলীপ, তৃণমূল কটাক্ষ করল, ‘‘ও সবই ভোটের নাটক।’’

১৪ ২১

দিলীপ মানে অন্য রকম কিছু। যেমন অভিনব তাঁর কাজ। তেমনই সরস কথাবার্তা। কিছু দিন আগে দিলীপের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার অ্যান্ডু ফ্লেমিংয়ের। তাঁর হাতে লক্ষ্মী এবং গণেশের মূর্তি তুলে দিয়েছেন দিলীপ। কারণ? এতে নাকি ইংল্যান্ডের আর্থিক পরিস্থিতি ভাল হবে! প্রথম দফা লোকসভা ভোটের দিন সকালে জনসংযোগের পর দুপুরে বর্ধমানের টাউন হলে একটি সম্মেলনে হাজির ছিলেন দিলীপ। সেখানে পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ। অতঃপর তাঁর হাতে উপহার তুলে দেন দিলীপ। পরে তিনি বলেন, ‘‘উনি গুজরাতি পরিবারের, তবে ব্রিটিশ নাগরিক। যেমন ঋষি সুনক পঞ্জাবি পরিবারের।’’ বিজেপি নেতার সংযোজন, ‘‘আমি বললাম, ‘ভারত এত দিন ধর্ম-সংস্কৃতি বিস্তার করত। অন্য জায়গা থেকে আমরা অন্য কিছু আনতাম, যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য। এখন আমরা দুনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ‘সাপ্লাই’ করছি।’ আমাদের দেশের সংস্কৃতির চিহ্ন দিলাম। লক্ষ্মী আর গণেশের রুপোর মূর্তি দিলাম।’’ এই উপহারের বিশেষত্ব? দিলীপের জবাব, ‘‘আমি ওঁকে বললাম, ‘দেখুন,আপনাদের দেশের আর্থিক অবস্থা ঠিক নেই। লক্ষ্মী-গণেশকে নিয়ে যান। ইংল্যান্ডের আর্থিক অবস্থা ভাল হয়ে যাবে।’ উনি নিয়ে গিয়েছেন। আমি রামমন্দিরের ক্যালেন্ডার দিলাম। সেটাও নিয়েছেন উনি। খুব ভাল কথাবার্তা হয়েছে। ওঁকে বর্ধমানের সীতাভোগ খাইয়েছি।’’

১৫ ২১

ভোটপ্রচারে নামার পর থেকেই নানাবিধ কারণেই বার বার সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছেন দিলীপ ঘোষ। বিতর্কিত মন্তব্য করে দলীয় নেতৃত্বের ‘বকুনি’ও খেতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু ইদের দিন এক অন্য দিলীপকে দেখেছে বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্র। ভোটপ্রচারে যাওয়ার সময় ইদ উপলক্ষে তৃণমূলের এক কর্মসূচিতে আচমকাই চলে গিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। সেখানে বসে চুমুক দিলেন শরবতেও। শাসকদলের নেতা-কর্মীদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাঝে বক্তৃতাও করলেন মাইক হাতে। তৃণমূলের কর্মসূচি থেকে বেরোনোর পর দিলীপ বলেন, ‘‘ইদ আনন্দের উৎসব। মুসলিম ভাইবোনেরা ছিলেন। তৃণমূলেরও লোক ছিল। আজ ইদ, পরে রামনবমীও হবে। আমি চাই, সমস্ত উৎসব যেন সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে পালিত হয়।’’

১৬ ২১

প্রাতর্ভ্রমণ, চা-চক্র সেরে কাগজ পড়ছিলেন বর্ধমান-দুর্গাপুরের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ। এক জন আলাপ করতে এসে পরিচয় দেন সরকারি কর্মচারী বলে। শুনেই দিলীপের মন্তব্য, ‘‘এরাই রিগিং করেন।’’ সবাই অবাক। মন্তব্য হালকা করে দিতে তাই ওই ব্যক্তির হাতে পদ্মফুল ধরিয়ে দিলেন দিলীপ। তার পর ‘আশ্বাস’ দিলেন, বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে অবসরের পরে ‘ফুল টাইম জব’ দেবেন তাঁকে। আবার, বেঙ্গালুরুর রামেশ্বরম ক্যাফেতে বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলা থেকে দুই অভিযুক্তের গ্রেফতারি নিয়ে দিলীপ ঘোষের মন্তব্যে বিতর্ক হয়েছে। ভোটপ্রচারে বেরিয়ে দিলীপের তোপ, ‘‘সবে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে। ইঁদুর, পোকামাকড় সব বেরোচ্ছে। ভোটের পর সব বেরিয়ে আসবে।’’

১৭ ২১

২০১৪ লোকসভা ভোটে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তার পর দুটো লোকসভা ভোট কেটে গিয়েছে। আবার একটি লোকসভা ভোট হাজির। তবে মোদীর দেওয়া অ্যাকাউন্টে-অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এখনও বিরোধীদের লব্জে টাটকা। ওই নিয়ে লোকসভা ভোটের প্রচারে বিজেপিকে নিশানা করছেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী থেকে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধীদের সেই কটাক্ষের প্রসঙ্গ উঠতেই ফুঁসে উঠতে দেখা গিয়েছে দিলীপ ঘোষকে। তার পর যে মন্তব্য করলেন, তা নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক। তৃণমূলের কটাক্ষ, এই সব কথা বলে সাধারণ মানুষকে অপমান করছেন বিজেপি প্রার্থী। কারণ, দিলীপ বলেছিলেন, ‘‘১৫ লক্ষ টাকার অপেক্ষা করে অনেকে তো উপরে চলে গেল! আমরা ১৫ কোটি টাকার কথা বলছি।’’ তিনি কোন ১৫ কোটি টাকার কথা বলছেন, তা অবশ্য পরিষ্কার করেননি।

১৮ ২১

ক্ষণিকের ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার জেলার কিছু অংশ। তা নিয়ে এমন কথা বললেন দিলীপ, যে অস্বস্তিতে পড়ে যায় তাঁর দল। ঝড় থামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলের উদ্দেশে বিশেষ বিমানে রওনা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর দিন যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। জলপাইগুড়িতে মমতা থাকার সময়েই ফোন পান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের। উদ্বেগ প্রকাশ করেন শাহ। আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্ধার এবং সেবাকাজে নেমে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দিলীপ ঝড়ের মধ্যে টেনে আনলেন ভোট-রাজনীতি, বললেন, ‘‘ঝড় তো উত্তরবঙ্গে শুরু হচ্ছে। ভোট ওই দিক থেকেই শুরু হচ্ছে। বিজেপির ঝড় শুরু হচ্ছে। তাতেই লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে।’’ শুধু তা-ই নয়, শাসকদলকে নিশানা করে দিলীপের মন্তব্য, ‘‘টিএমসির পোয়াবারো। যা মাল আসবে ঝেড়ে ফাঁক করে দেবে।’’ ‘বন্যা হোক। ঝড় হোক— ওরা এটাই চায়। তাতে কামাই হবে।’’

১৯ ২১

ভুল মূর্তিতে মাল্যদান করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দিলীপ ঘোষ অবশ্য দাবি করেছিলেন শাহ যখন মূর্তিতে মালা দিয়েছেন, তখন সেটিই বিরসা মুন্ডারই মূর্তি। কিছু দিন আগে নিজেই ভুল মূর্তিতে মালা দিয়ে বিতর্কে জড়ান বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভার বিজেপি প্রার্থী দিলীপ। তার পর মূর্তির পরিচয় শুনে দিলীপের কৌতূহলী প্রশ্ন, ‘‘এখানে আবার কপূর এল কোথা থেকে?’’ আসলে বর্ধমানের রাজা ভেবে রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠের গলায় মালা দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এবং তার পর জয়ধ্বনি দিলেন, ‘মহারাজ উদয়চাঁদ অমর রহে’। ঠিক ওই সময়েই ঘনিষ্ঠেরা দিলীপকে বোঝান, ওটা বনবিহারী কপূরের মূর্তি। যা শুনে দৃশ্যত বিস্মিত হয়ে যান বিজেপি নেতা।

২০ ২১

দিলীপ বলেন, তিনি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। বাংলায় নাকি যে কোনও ইস্যুতে প্রতিবাদ হয়। আন্দোলন হয়। কিন্তু তাতে প্রতিবাদী বা আন্দোলনকারীদের অভীষ্ট পূরণ হয় না। প্রচারে বেরিয়ে স্থানীয়দের কথা শুনছিলেন দিলীপ। এক জন জানান, বেআইনি ভাবে মাঠের জায়গায় বহুতল নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে মাঠ ছোট হয়ে আসছে। এ বিষয়ে দিলীপকে পদক্ষেপ করতে আবেদন করেন। প্রত্যুত্তরে দিলীপ বলেন, ‘‘মেনটেন করা তো আমাদের হাতে থাকবে না। তবে কব্জা যাতে না হয়ে যায়, সেটা দেখা আমার দায়িত্ব। তার পর সময়ে অনেক কিছুই হবে।’’ ওই প্রেক্ষিতেই দিলীপ-বাণী, ‘‘বাংলায় প্রতিবাদ এবং আন্দোলন করার একটা ফ্যাশন আছে। কাজ কিছু হয় না। আর আমি নিবেদন-আবেদন করি না কারও কাছে, আমি অ্যাকশন করি।’’

২১ ২১

দিলীপ সব সময়ে ‘রগড়ানো’র কথা বললেও হাসি-ঠাট্টাও যে করেন না, তা একেবারেই নয়। এই কিছু দিন আগে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে কার্জনগেটের কাছে ফল বাজার করছিলেন। টাকা দিয়ে কিনেছেন, বেল আর তরমুজ। বেল হাতে নিয়ে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘‘ভাবছি কার মাথায় ভাঙব।’’ মন্তব্যের সমালোচনা করে শাসকদল বলে, ‘‘দিলীপ বুঝতে পেরেছেন উনি হারবেন। হার নিশ্চিত বুঝতে পেরে ওঁর মতিভ্রম হয়েছে। তাই নানা কুকথা বলছেন।’’ দিলীপ অবশ্য ফুৎকারে ওড়াচ্ছেন সে সব। তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বী বিহারবাসী কীর্তি আজ়াদের উদ্দেশে বিজেপি প্রার্থীর কটাক্ষ, ‘‘বর্ধমান-দুর্গাপুরের লোক ওঁকে চার তারিখের পর ‘প্যাক’ করে পাঠিয়ে দেবেন। চার তারিখ বাকি আছে। তত দিন ‘দিলীপ-দর্প’ চলবেই।

সব ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement