সামনে দেখা যাচ্ছে রানওয়ে। ককপিটে বসে চালক। নাটকীয় ভাবে অবতরণ করল বিমানটি। সরু রানওয়ে দিয়ে এঁকেবেঁকে গিয়ে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন চালক। খানিক কেঁপে থামল সেই বিমান। বিগত কয়েক মিনিট ধরে বুক ধড়ফড় করছিল যে যাত্রীদের, হাততালি দিয়ে উঠলেন তাঁরা।
ভুটানের পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান অবতরণের এমন ঘটনা মোটামুটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর যে কারণে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দরের তকমা পেয়েছে পারো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুটানে ১৮ হাজার ফুট উঁচু দু’টি পর্বতচূড়ার মধ্যে অবস্থিত এই ছোট্ট বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিমান ওঠানামার জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং স্নায়ুর জোর— উভয়ই প্রয়োজন।
এমনিতে পারো থেকে উড়ান এবং অবতরণ এড়িয়েই চলেন যাত্রীরা। তবে যাঁরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং রোমাঞ্চ পছন্দ করেন, তাঁরাই মূলত পারোয় যান।
সংবাদমাধ্যম ‘সিএনএন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী পারো প্রসঙ্গে ভুটানের বিমানচালক চিমি দরজি বলেছেন, ‘‘পারো বিমানবন্দরে বিমান নিয়ে ওঠানামা কঠিন, কিন্তু বিপজ্জনক নয়।’’ গত ২৫ বছর ধরে ভুটানের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান সংস্থা ড্রুক এয়ার বা রয়্যাল ভুটান এয়ারলাইন্সে কাজ করছেন চিমি।
চিমি আরও বলেছেন, ‘‘পুরো বিষয়টি চালকের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। পারোয় বিমান ওড়ানো চ্যালেঞ্জিং, তবে বিপজ্জনক নয়। কারণ, বিপজ্জনক হলে আমি নিজেই ওড়াতে পারতাম না।’’
ভৌগোলিক কারণে পারো এবং সর্বোপরি ভুটানের বেশির ভাগ অংশের দৃশ্য মনোরম। তবে পারোয় বিমান চালানোর জন্য চালকদের সত্যিই বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়।
পারো একটি ‘ক্যাটাগরি সি’ বিমানবন্দর। যার অর্থ ওই বিমানবন্দরে বিমান চালানোর জন্য চালকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। চালকদের অবশ্যই রাডার ছাড়া বিমান ওঠানো-নামানোর প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।
প্রশিক্ষণের সময় পারো বিমানবন্দরের চারপাশের এলাকা হাতের তালুর মতো চেনানো হয় বিমানচালকদের। এক ইঞ্চি এ পাশ-ও পাশ হয়ে গেলেও বিপদ ঘটে যেতে পারে।
সমাজমাধ্যমে চিমি বলেছেন, ‘‘পারোয় বিমান চালানোর জন্য আপনাকে সত্যিই দক্ষ হতে হবে। পুরো এলাকা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। আমরা একে ‘এরিয়া কম্পিটেন্স ট্রেনিং’ বলে থাকি। পাশাপাশি চালকদের ‘রুট ট্রেনিং’ও দেওয়া হয়।’’
ভারত এবং চিনের মধ্যে থাকা ভুটানের ৯৭ শতাংশ পর্বত। রাজধানী থিম্পু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৭১০ ফুট উপরে। পারো রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৩৮২ ফুট উঁচুতে।
চিমা জানিয়েছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে যাওয়া হবে বাতাসের ঘনত্ব তত কমবে। তাই পারোয় বিমানটিকে অবশ্যই দ্রুত উড়তে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
নয়াদিল্লি, ব্যাঙ্কক হোক বা কাঠমান্ডু— যেখান থেকেই যাত্রীরা পারো বিমানবন্দরে রওনা দিন না কেন, তাঁদের খুব সকালে বিমানে চাপতে হয়। কারণ, আবহাওয়ার কারণে নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা চান যে, সব বিমান দুপুরের আগেই বিমানবন্দরে অবতরণ করুক।
চিমির কথায়, ‘‘আমরা দুপুরের পরে বিমান অবতরণ এড়িয়ে যাই। কারণ দুপুরের আগে বাতাসে তাপমাত্রা বেশি থাকে। বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম থাকে। তাই জমিও শুকনো থাকে। কিন্তু দুপুরের পর আবহাওয়ায় বদল আসে।’’ যদিও বিমান ওড়়ানের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয় না। তবে বর্ষাকালে বিমানচালকদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয় বলে জানিয়েছেন চিমি।
উল্লেখ্য, রাডারের অভাবে রাতের বেলায় পারো থেকে কোনও বিমান ওড়ে না। কোনও মরসুমেই ওড়ে না।
চিমি আরও জানিয়েছেন, পারোয় বিমানবন্দরে ওঠানামা করতে হলে একজন চালককে কখন উড়তে হবে, তার থেকেও বেশি কখন উড়তে হবে না, তা জানা বেশি জরুরি।
পারোয় বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে আরও অন্তরায় এর চারপাশে থাকা পাহাড়ি ভূখণ্ড। পারোর রানওয়ে মাত্র ৭,৪৩১ ফুট লম্বা এবং এর দু’পাশে দুটি উঁচু পর্বতচূড়া রয়েছে। ফলস্বরূপ, বিমানচালকেরা বিমানবন্দরের একেবারে কাছাকাছি এসে অবতরণ করতে পারেন।