বয়স মাত্র সতেরো। চোখে রঙচঙে স্বপ্ন। কিন্তু পকেটে মাত্র ৫০০ টাকা। এইটুকু সম্বল করেই বাড়ি ছেড়ে মুম্বইয়ে পা রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু মুখের আদল অনেকটাই মিঠুন চক্রবর্তীর মতো হওয়ার কারণে বার বার ছবি নির্মাতাদের দরজা থেকে ফিরে এসেছেন এই অভিনেতা। আবার মিঠুনের কারণেই সিনেমাপাড়া থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তাঁকে।
তিনি রবি কিষণ। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু কালের গতিতে হিন্দি ফিল্মজগতের তুলনায় ভোজপুরী ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয় করেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন রবি।
১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই মুম্বইয়ের সান্তা ক্রুজে জন্ম রবির। কিন্তু পারিবারিক ব্যবসা সংক্রান্ত ঝামেলা হওয়ার কারণে দশ বছর মুম্বইয়ে থেকে তাঁরা উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরে চলে যান। শৈশব থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল রবির।
১৭ বছরে পা পড়তে না পড়তেই পকেটে মাত্র ৫০০ টাকা নিয়ে উত্তরপ্রদেশের বাড়ি থেকে পালিয়ে মুম্বইয়ে চলে যান রবি। সেখানে গিয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু মুম্বইয়ে হাজারো অডিশন দেওয়ার পরেও কাজের প্রস্তাব পাননি তিনি।
এক পুরনো সাক্ষাৎকারে রবি জানিয়েছেন যে, উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন বলে রবিকে অনেকেই ‘দুধওয়ালা’, ‘ঠেলাওয়ালা’ বলে সম্বোধন করতেন।
আবার বলিপাড়ার অন্য এক অভিনেতার জন্যও কাজ পাননি রবি। টিনসেল নগরীর অধিকাংশের দাবি, রবির মুখাবয়ব অনেকটা মিঠুন চক্রবর্তীর মতো। মিঠুনের মতো দেখতে বলেই নাকি বলিপাড়ার ছবি নির্মাতারা রবিকে ফিরিয়ে দিতেন। আবার অনেকে তাঁকে ‘মিঠুনের সস্তা কপি’ বলেও ডাকতেন।
১৯৯২ সালে প্রথম হিন্দি ছবিতে কাজ করেন রবি। ‘পীতাম্বর’ ছবিতে অভিনয় করে পাঁচ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি। অভিনেতা জানান যে, প্রথম পারিশ্রমিক দিয়ে নিজের জন্য একটি বাইক কিনেছিলেন রবি।
হিন্দি ছবির পাশাপাশি হাতেগোনা কয়েকটি ধারাবাহিকেও কাজ করা শুরু করেছিলেন রবি। তবে রবির কেরিয়ারের রেখচিত্র তরতরিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে ২০০৩ সালে।
২০০৩ সালে ভোজপুরী ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পান রবি। তার পর আর অভিনেতাকে নিজের কেরিয়ারে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ভোজপুরী ছবিতে অভিনয় করে গিয়েছেন তিনি।
ধীরে ধীরে রবির অনুরাগী মহল তৈরি হয়ে যায়। ভোজপুরী সিনেমার দর্শক অভিনেতাকে বলিউডের অমিতাভ বচ্চনের মতো দেখতেন। ভোজপুরী ইন্ডাস্ট্রিতে নামডাক হওয়ার পর আবার হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
‘তেরে নাম’, ‘ফির হেরা ফেরি’, ‘লাক’, ‘তনু ওয়েডস মনু’, ‘এজেন্ট বিনোদ’-এর মতো ছবিতে অভিনয় করেন রবি। এ ছাড়াও তামিল, তেলুগু, কন্নড়, গুজরাতি ভাষার ছবিতেও কাজ করতে দেখা যায় তাঁকে।
তবে যে অভিনেতার জন্য কাজ পাচ্ছিলেন না রবি, তাঁর জন্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে নাকি বাদ পড়েছিলেন অভিনেতা। রবিকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কারণ তিনি মিঠুনকে সমর্থন করেছিলেন।
২০০৪ সালে টলিউডে মুক্তি পেয়েছিল মিঠুন অভিনীত বাংলা ছবি ‘কুলি’। মিঠুনের দাবি, কোনও অনুমতি ছাড়াই মিঠুনের ছবিটি ভোজপুরী ভাষায় ডাব করা হয়েছে। এই বিষয়ে রবি সমর্থন করেছিলেন মিঠুনকে।
কিন্তু বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের মোশন পিকচার প্রোডিউসার’স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে রবিকে ‘ব্যান’ করে দেওয়া হয়। সংস্থার তরফে জানানো হয় যে। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে অভিনেতা তাঁর কোনও ছবির শুটিং করতে পারবেন না। এমনকি, এই দুই রাজ্যের কোনও প্রেক্ষাগৃহে রবির ছবি মুক্তি পাবে না।
এই প্রসঙ্গে প্রযোজক অভয় সিংহ জানিয়েছিলেন যে, যদি বিহারে রবির ছবির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় তবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থমকে যাবে। অভিনেতার উপর যে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা রয়েছে তা-ও জানান অভয়।
তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে জানার পর রবি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তের পর আমি কোনও দায়িত্ব নিতে পারব না। আমার অনুরাগীদের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা-ও জানি না আমি।’’
২০০৯ সালে ‘লাক’ ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে অভিনয় করতে দেখা যায় রবিকে। এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইমরান খান, শ্রুতি হাসান, সঞ্জয় দত্ত, ড্যানি ডেনজ়ংপার মতো তারকা।
এক পুরনো সাক্ষাৎকারে রবি জানান যে, অভিনয়ে নামবেন বলে নিজের পদবি বদলে ফেলেছিলেন অভিনেতা। তাঁর আসল নাম ছিল রবি শুক্ল। কিন্তু অভিনয়ে নামার আগে শুক্লর পরিবর্তে কিষণ ব্যবহার করেন তিনি।
অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতিতেও যোগ দেন রবি। ২০১৪ সালে কংগ্রেস দলে যুক্ত হন তিনি। লোকসভা নির্বাচনের সময় জৌনপুর থেকে ভোটে দাঁড়ান তিনি। কিন্তু ভোটে হেরে যান রবি।
২০১৭ সালে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদেন রবি।২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে গোরক্ষপুর থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে জেতেন তিনি।
২০২২ সালে শেষ ‘লভ ইউ লোকতন্ত্র’ ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে রবিকে। ২০০৬ সালে ‘বিগ বস্’ রিয়্যালিটি শোয়েও অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এ ছাড়াও বহু টেলিভিশন শোয়ের সঞ্চালকের ভূমিকায় কাজ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।